আর্থিক সেবা খাতের যান্ত্রিকীকরণে কৌশলী হতে হবে: ড. আতিউর রহমান

354
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান বলেছেন, আর্থিক সেবা খাতে বেপরোয়া যান্ত্রিকীকরণের পরিণাম মারাত্মক হতে পারে। এক্ষেত্রে অবশ্যই কৌশলী হতে হবে এবং বাস্তবতার নিরিখে পদক্ষেপ নিতে হবে।
আজ বৃহস্পতিবার দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে এ তিনি কথা বলেন। সাউথ আফ্রিকান সোসাইটি ফর ব্যাংক অফিসিয়ালস (সাসবো) ফাইনান্স সেক্টর ইনডাবা (কংগ্রেস) ২০১৮- এর একটি অধিবেশনে “শেইপিং আওয়ার ফিউচার ফাইনান্স: ডিজিটাইজেশন, ইনোভেশন এন্ড জব ক্রিয়েশন” শিরোনামে নিবন্ধ উপস্থাপনের সময় তিনি এ কথা বলেন।
ড. আতিউর বলেন, যেকোনো শিল্পেই যান্ত্রিকীকরণ অবধারিত। যান্ত্রিকীকরণের ফলেই অধিকাংশ উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ আদিম অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে ক্রমান্বয়ে শিল্প ও সেবা খাত নির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু অপরিকল্পিত যান্ত্রিকীকরণের ফলে প্রচুর কর্মী কাজ হারালে বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে। তবে আমরা যদি এক্ষেত্রে কৌশলী হই অর্থাৎ- একবারে পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়া যান্ত্রিকীকরণ না করে, একটি অংশের পরে আরেকটি অংশ যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে এগোই, তাহলে কর্মীরা মানিয়ে নেয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় পাবে। যান্ত্রিকীকরণের ফলে যে উৎপাদনশীলতা ও মুনাফা বাড়বে এবং তাতে বিনিয়োগও বহুমুখী হবে। ফলে নতুন কর্মসংস্থানও তৈরি হবে। বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পে ঠিক এমনটিই ঘটছে। এখানে কর্মীরা কাজ করতে করতে শেখার সুযোগ পাচ্ছে এবং আধুনিক কর্মপদ্ধতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বর্ধিষ্ণু পর্যায়ে রয়েছে, আর তাই দেশের প্রধান ম্যানুফ্যাকচারিং খাত (অর্থাৎ গার্মেন্ট খাত) অন্তত আরো দুই দশক প্রবৃদ্ধির ধারায় থাকবে। এ খাতের মুনাফা বিনিয়োগ বহুমুখীকরণে কাজে লাগানো যাবে। আসন্ন মার্কিন-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতের সাশ্রীয় ও টেকসই পণ্য উৎপাদনের দক্ষতার কারণে এই খাত বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকবে এবং এর ফলে অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ হবে ও কর্মসংস্থান তৈরি হবে।
বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ের আর্থিক অন্তর্ভূক্তি নীতির আওতায় দেশটির আর্থিক সেবা খাত ব্যাপকভিত্তিক ডিজিটাইজেশনে উদ্যোগী হয়েছে এবং ইতোমধ্যেই বিভিন্ন উদ্ভাবনী উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগে পেমেন্ট সিস্টেম ও ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের আধুনিকীকরণ, কৃষি ও এসএমই খাতকে সহায়তার পাশাপাশি ইন্টারনেটের ব্যাপক ব্যবহার, মোবাইল ব্যাংকিং ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে
দেশের ব্যাংকগুলো বহু লক্ষ নতুন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা তৈরি করতে ভূমিকা রেখেছে।
যান্ত্রিকীকরণের কারণে মূল ধারার ব্যাংকিংয়ে যতোটুকু কর্মসংস্থান কমেছে, উদ্যোক্তা তৈরির ফলে তারচেয়ে বহুগুণ বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা গেছে। ব্যাংকগুলো বিভিন্ন তথ্য প্রযুক্তিভিত্তিক আর্থিক সেবাদানকারিদের সাথে এক সাথে কাজ করার মাধ্যমে দেশের প্রায় সব নাগরিককে আনুষ্ঠানিক আর্থিক সেবার আওতায় নিয়ে আসতে পেরেছে।
আইসিটিভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে বিপুল সংখ্যক নারীরা ই-কমার্স নির্ভর উদ্যোক্তা বা অন্যান্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা হিসেবে আবিভর্‚ত হচ্ছেন।
মোবাইল ব্যাংকিং ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের কারণে সারাদেশে প্রায় দশ লক্ষ এজেন্ট নতুন আর্থিক সেবা উদ্যোক্তা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছেন, এবং আরো প্রায় বিশ লক্ষ লোকের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। যে সব উদ্যোক্তারা যান্ত্রিকীকরণে আগ্রহী তাদের উৎসাহিত করা উচিৎ বলে মনে করেন ড. আতিউর। পাশপাশি কর্মীরা যেন কর্মক্ষেত্রে সুস্থ পরিবেশ পান সেজন্যও এসব উদ্যোক্তাদেরকে অনুপ্রাণিত করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, কর্মীদের ভালো থাকার জন্য বিনিয়োগ করাটা নতুন প্রযুক্তির পেছনে বিনিয়োগ করার মতোই অতি গুরুত্বপূর্ণ।
নিবন্ধ উপস্থাপন শেষে উন্মুক্ত আলোচনায় এক প্রশ্নের জবাবে ড. আতিউর বলেন-আর্থিক সেবা খাতে কাজ করার সময় একটি মানবিক কর্ম পরিবেশ পাওয়া এবং শেখার ও উদ্ভাবনি উদ্যোগ নেয়ার সুযোগ পাওয়া প্রতিটি কর্মীর অধিকার।
তিনি আরো বলেন, দেশের শিক্ষা খাতেও এমন বিনিয়োগ করা উচিত যাতে করে ছাত্ররা ডিজিটাল প্রযুক্তি সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান লাভ করে। এর ফলে শিক্ষা জীবন শেষে তরুণরা সহজেই ডিজিটাল আর্থিক সেবা খাতের অংশ হয়ে উঠতে পারবে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। তাঁর মতে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক সেবা খাত ও শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের কাজটি করতে পারে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here