ওসি প্রদীপের রোষের শিকার দুই ভাই-ক্রসফায়ার ক্রস-চেক/ রাতে চাঁদা চেয়েছিল ৮ লাখ, সকালেই দুই ভাই লাশ

225

 

নিজস্ব ডেস্ক>>
চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার দুই সহোদর ভাইকে তুলে নিয়ে গিয়ে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে হত্যা করেন টেকনাফ থানার বহিষ্কৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। চন্দনাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কেশব চক্রবর্তীর যোগসাজশে ওই দুই ভাইকে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করা হয়েছে বলে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে নিহত’ দুই ভাইয়ের স্বজনদের অভিযোগ। গত ১৬ জুলাই টেকনাফ থানা এলাকায় ‘ইয়াবা কারবারি হিসেবে বন্দুকযুদ্ধে নিহত’ হওয়া দুই ভাইয়ের একজন ছিলেন প্রবাসী। এদের নামে কোনো থানায় একটি মামলা কিংবা জিডিও ছিল না। যখন ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, তখনও কোনো অভিযোগ ছিল না।

করোনাকালীন সংকটে নিরূপায় হয়ে দেশে ফেরেন বাহরাইনপ্রবাসী ছোট ভাই আজাদ। দেশে ফেরার ২ মাস ১৪ দিনের মাথায় গত ১৩ জুলাই এক বন্ধুর ফোন পেয়ে চন্দনাইশের কাঞ্চননগর ইউনিয়নের নিজ ঘর থেকে বের হয়ে আর ঘরে ফেরেননি আজাদ। টানা দুই দিনেও আজাদের কোনো খোঁজ না পেয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি করার সিদ্ধান্ত নেয় তার পরিবারের সদস্যরা।

ছোট ভাই নিখোঁজ হওয়ার ঠিক দুদিন পর ১৫ জুলাই বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজের সামনের ভাড়া বাসায় অভিযান চালিয়ে আজাদের বড় ভাই ফারুককে আটক করে নিয়ে যায় চন্দনাইশ থানা পুলিশ। চন্দনাইশ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) তাৎক্ষণিকভাবে পরিবারের সদস্যদের জানায়, কোনো মামলা না থাকলেও সন্দেহভাজন হিসেবে ফারুককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরিদর্শক (তদন্ত) এও নিশ্চিত করেন, ওসি কেশব চক্রবর্তীর নির্দেশেই ফারুককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওসি বাইরে গেছেন, তিনি থানায় ফিরলে জিজ্ঞাসাবাদ করে ফারুককে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে তিনি অবশ্য আশ্বস্ত করেন। পুলিশের পরামর্শে সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ আবারও স্বজনরা চন্দনাইশ থানায় গেলে জানানো হয় টেকনাফ থানায় ১৪ জুলাই দায়ের করা একটি মামলায় ফারুককে টেকনাফ থানায় পাঠানো হয়েছে।

এদিকে থানা থেকে ফেরার কয়েক ঘন্টার মাথায় ফারুক ও আজাদের মায়ের মোবাইলে একটি নম্বর থেকে ফোন করে অজ্ঞাত পরিচয় একজন বলেন, ‘তোর দুই ছেলে আমাদের কাছে আছে। দুই ছেলেকে জীবিত ফেরত চাইলে রাতের মধ্যে আমাদের ৮ লাখ টাকা দিতে হবে। না হলে সকালে ছেলের লাশ পাবি।’ একথা বলেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়।

যেমন কথা তেমন কাজ। এর পরদিন ১৬ জুলাই সকাল ৮টা নাগাদ টেকনাফ থানা থেকে তাদের মায়ের নম্বরে ফোন করে জানানো হয় দুই ভাই আজাদ ও ফারুক টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে।

ওই সময় টেকনাফ থানার পক্ষ থেকে দেওয়া এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়, ‘চট্টগ্রামের চন্দনাইশ এলাকা থেকে মাদক সংগ্রহ করতে এসে কক্সবাজারের টেকনাফে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে দুই ভাই নিহত হয়েছেন।’

মেজর (অব.) সিনহা রাশেদ হত্যামামলার আসামি টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ওই সময় জানিয়েছিলেন , টেকনাফের মৌলভীপাড়া এলাকায় ইয়াবা ক্রয় করতে এলে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আজাদুল হক নামে একজনকে আটক করা হয়। পরে তার তথ্যের ভিত্তিতে মূল হোতা বড় ভাই ফারুককে আটক করা হয়। এ সময় তারা স্বীকার করে দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামে সরবরাহ ইয়াবা করে আসছিল। একপর্যায়ে দুই ভাইকে নিয়ে চকবাজার এলাকায় ইয়াবা উদ্ধার অভিযানে গেলে সহযোগীরা পুলিশের ওপর গুলি ছোঁড়ে।

আজাদের বড় বোন আইরিন আক্তার বলেন, ‘আজাদ মাত্র কদিন আগে প্রবাস থেকে ফিরেছিল। যেদিন সে নিখোঁজ হয় সে সময় সে দুপুরের খাবার খেয়ে শুয়েছিল। হঠাৎ একটা কল আসে তার মোবাইলে। তাকে বলতে শুনেছি, আচ্ছা আমি বের হচ্ছি দোস্ত। এভাবে নিশ্চয়ই কেউ ইয়াবা কিনতে চন্দনাইশ থেকে টেকনাফ চলে যাবে না?’

তিনি বলেন, ‘আসলে আজাদের কোনো বন্ধুকে দিয়ে ফাঁদ পেতে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরে একই কায়দায় নিয়ে যাওয়া হয় ফারুককে। আমার দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে কোন মামলা বা ওয়ারেন্ট ছিল না। অথচ তাদেরই কিনা এভাবে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হলো? আমরা কার কাছে গিয়ে বিচার চাইবো? আমার বৃদ্ধা মা কিভাবে নিজেকে সান্তনা দেবেন? ফারুকের ১০ বছর বয়সী একটা মেয়ে আর ১ বছরের একটা ছেলে আছে। তাদের কী হবে?’

এদিকে শুরু থেকেই ফারুককে গ্রেপ্তার করা কিংবা টেকনাফ থানায় হস্তান্তরের কথা সাফ অস্বীকার করে আসছিলেন চন্দনাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কেশব চক্রবর্তী। তিনি বলছিলেন, এই বিষয়ে চন্দনাইশ থানা পুলিশ কিছুই জানে না। দুই সহোদরের মৃত্যুর পর বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমকে এমন কথাই বলেছিলেন তিনি। ফারুককে আটক এবং এরপর টেকনাফ থানায় হস্তান্তরের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন কেশব চক্রবর্তী।

তিনি বলেন, ‘ফারুককে কোন মামলা বা ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে তার পরিবার যে দাবি করছে তা সঠিক নয়। কারণ অবশ্যই আছে।’ ঠিক কোন্ অভিযোগে কোন্ প্রক্রিয়ায় ফারুককে গ্রেপ্তার ও টেকনাফ থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে— এমন প্রশ্নের জবাবে কেশব চক্রবর্তী বলেন, ‘সব তো আর ফোনে বলা যাবে না। আপনি থানায় আসুন। থানায় আসলে এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারবেন।’

কেন দুই ভাই ওসি প্রদীপের রোষের শিকার?
পরিবারের অভিযোগের সূত্র ধরে ফারুক ও আজাদের পরিবারের সদস্যদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল ঠিক কী কারণে ওসি প্রদীপের এমন রোষানলের হলেন শিকার দুই ভাই? উত্তরে তাদের বড় বোন আইরিন আক্তার বলেন, ‘আমি জানি না কেন আমার ভাইদের সাথে এমন ঘটলো? তবে খালি এটি বলতে পারি এই সম্পর্কে পুলিশ যা বলেছে তা সত্য নয়। আমার দুই ভাইকেই পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। কেন কী হয়েছে সে বিষয়ে তদন্ত করে সত্য ঘটনা প্রকাশ করা হোক।’

পরিবারের কেউ এই বিষয়ে কথা বলতে রাজি না হলেও চট্টগ্রাম অনুসন্ধানে জানা গেছে, বছরদুয়েক আগেও ফারুকের বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসার অভিযোগ ছিল। সে সময়ে বিষয়টি জানাজানি হলে ফারুকের মা এলাকাবাসীকে ডেকে রীতিমতো বিচার বসিয়েছিলেন নিজের ছেলের বিরুদ্ধেই। এই পথ থেকে সরে না আসা পর্যন্ত ফারুককে নিজের ছেলে বলে পরিচয় দেবেন না বলেও সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সে সময় ফারুককে বাড়ি থেকে বেরও করে দেন তার বৃদ্ধা মা। পরে মা ও এলাকাবাসীর চাপে মাদক ব্যবসা ছেড়ে দেন ফারুক। তবে সবসময় একটা ভয়ে থাকতেন তিনি।

স্থানীয় একজন সমাজকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মায়ের কট্টর অবস্থানের কারণে বছরখানেক আগ থেকে ইয়াবা ব্যবসা ছেড়ে দেয় ফারুক। কিন্তু তার একটা ভয় ছিল। যে এই লাইন ছেড়ে দিলে সে বিপদে পড়তে পারে। এই কারণে সে আলাদা বাসায় থাকতো। আমাদের ধারণা তার ভয়টাই সত্যি হয়েছে। ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার মাশুল হিসেবেই তার ওপর ক্ষোভ ছিল এই চক্রের সদস্যদের। আর এই কারণে তার ছোট ভাইকে তুলে নিয়ে গিয়ে তার কাছ থেকে ফারুকের ঠিকানা বের করে। পরে দুই ভাইকে এক সাথেই হত্যা করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘আজাদের লাশের শরীরে প্রচুর আঘাতের চিহ্ন ছিল। মাত্র ২ মাস আগে বিদেশ থেকে আসা আজাদ কোনো কিছুতেই জড়িত ছিল না। আমাদের অভয়ে ফারুক এই পথ ছেড়ে দিয়েছিল। এর মাশুল এভাবেই দিতে হলো— এটা ভেবে খারাপ লাগছে। এই ঘটনার তদন্ত করা উচিত। কারণ মাদক ব্যবসা ছেড়ে দেয়ার জন্য যদি সত্যিই এমন মাশুল দেওয়া লাগে তাহলে কোনভাবেই দেশ মাদকমুক্ত হবে না।’

সূত্র চট্টগ্রাম প্রতিদিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here