করোনা রোগীর ভার নিতে চায় না চট্টগ্রামের সবচেয়ে সক্ষম হাসপাতালটিই

375

 

চট্টগ্রামে ৬ হাজার করোনা রোগীর বিপরীতে সবগুলো হাসপাতালে আছে মাত্র ৫৫০ শয্যা। অথচ ঢাকায় শুধুমাত্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই করোনার শয্যা রয়েছে ৮০০টি। ঢাকায় যেভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ এগিয়ে এসেছে একইভাবে চট্টগ্রামে দায়িত্ব নিতে হবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকেই। এখন পর্যন্ত ১৫০ শয্যা নিয়ে করোনার চিকিৎসা দেওয়া দেশের অন্যতম এই শীর্ষস্থানীয় সরকারি হাসপাতালটি তার সামর্থ্যের ৫ ভাগের এক ভাগও এখনও দিচ্ছে না।

৫ হাজার ৯১১ জন— চট্টগ্রামে শুক্রবার পর্যন্ত করোনা পজিটিভ শনাক্ত হওয়া রোগীর মোট সংখ্যা। এর মধ্যে মারা গেছেন ১৩৬ জন। যতো বেশি নমুনা পরীক্ষা, ততো বেশি ধরা পড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা। এই বিশালসংখ্যক রোগীর বিপরীতে চট্টগ্রামের সবগুলো হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য প্রস্তুত রয়েছে মাত্র ৫৫০টি শয্যা। অথচ ঢাকায় শুধুমাত্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই করোনা রোগীদের জন্য শয্যা রয়েছে ৮০০টি।

এমন দুর্যোগময় মুহূর্তে যখন চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা নিয়ে প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে বঞ্চনার নির্মম সব গল্প, তখন স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বশীলরা আইসোলেশন সেন্টার বাড়িয়েই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে আইসোলেশন ওয়ার্ড বাড়ানোকে সমর্থন করলেও করোনা চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাসপাতালে শয্যা বাড়ানোটা তার চেয়েও বেশি জরুরি। তারা বলছেন, ঢাকায় যেভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ এগিয়ে এসেছে একইভাবে চট্টগ্রামে দায়িত্ব নিতে হবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকেই। এখন পর্যন্ত ১৫০ শয্যা নিয়ে করোনার চিকিৎসা দেওয়া দেশের অন্যতম এই শীর্ষস্থানীয় সরকারি হাসপাতালটি তার সামর্থ্যের ৫ ভাগের এক ভাগও এখনও দিচ্ছে না বলে অভিমত তাদের।

দেখা গেছে, অন্য রোগীদের অসুবিধা হবে— এমন অজুহাত দেখিয়ে বারবারই দায় এড়িয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রামের সবচেয়ে সক্ষম হাসপাতালটি। অথচ সেখানে অন্য রোগীর সংখ্যা গত তিন মাস ধরেই হাতেগোণার পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। কিডনি রোগী, হার্টের রোগী, ডায়াবেটিস রোগীরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে প্রচুর সংখ্যায়। এটা সামনে আরও বাড়বে। এসব রোগীকে চিকিৎসা দেওয়ার সক্ষমতা চমেক হাসপাতাল ছাড়া চট্টগ্রামে আর কারও সেভাবে নেই। চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আজ হোক কাল হোক করোনা চিকিৎসার মূল দায়িত্বটা নিতে হবে চমেক হাসপাতালকেই। সুতরাং পরে যা করতেই হবে, সেটা এখন কেন নয়?

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাসপাতালটির ডেন্টাল ইউনিট ও কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগ এখন অনেকটাই অব্যবহৃত অবস্থায় আছে। তাছাড়া বহির্বিভাগেও সবমিলিয়ে দিনে ৮-১০ জনের বেশি রোগী সেবা নিতে আসে না। এই তিনটি ভবনকে বিবেচনায় নিয়ে অনায়াসেই এখানে করোনাভাইরাস চিকিৎসার শয্যাসংখ্যা ৫০০ থেকে ৬০০ বাড়ানো যায়। এমনকি মেডিকেলের পেছনের খালি মাঠে আইসোলেশন সেন্টার করেও সেবার পরিসর কিছুটা বাড়ানো যায়।

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপের) কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান বলেন, ‘বহির্বিভাগে এখন দিনে মাত্র ৮ থেকে ১০ জন রোগী সেবা নেয়। এটি সেখান থেকে সরিয়ে নিলে সেখানে অন্তত ২০০ শয্যার ব্যবস্থা হবে। আপাতত এটা করে পরে পর্যায়ক্রমে আরও বাড়ানো যেতে পারে। তবে চমেকের যে সক্ষমতা সেটা কাজে লাগানোর কোন বিকল্প নেই এই মুহূর্তে।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. ফরহাদ উদ্দীন চৌধুরী মারুফ বলেন, ‘চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের যে সক্ষমতা, তাতে করে এই পরিস্থিতিতে ১৫০ শয্যার কোভিড চিকিৎসা খুবই অপ্রতুল। এটিকে অন্তত ৫০০ থেকে ৬০০ শয্যায় পরিণত করা দরকার। আমার মনে হয় ওখানকার স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বশীলরা একটু চেষ্টা করলেই এটা সম্ভব।’

তিনি বলেন, ‘শুরুতে এটাকে পরিকল্পনায় না রাখাটা একটা বড় ভুল ছিল। দেখুন কিডনি রোগী, হার্টের রোগী, ডায়াবেটিস রোগীরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে প্রচুর সংখ্যায়। এটা আরও বাড়বে হয়তো। এসব রোগীকে চিকিৎসা দেওয়ার সক্ষমতা চট্টগ্রামে চমেক হাসপাতাল ছাড়া আর কারও সেভাবে নেই। কাজেই এটা কিছুদিন পরে হলেও করতে হবে। যেটা পরে করতেই হবে, সেটা এখন কেন নয়?’

তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেলে করোনা চিকিৎসার পাশাপাশি অন্যান্য সব সেবাও চলছে। আপৎকালীন সময় বিবেচনায় সেসব সেবার পরিসর কমানো হয়েছে। চট্টগ্রামেও এটা বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।’

দেখা গেছে, অন্য রোগীদের অসুবিধা হবে— এমন অজুহাত দেখিয়ে চট্টগ্রামে করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে অনেকটা আড়ালে রেখেই সব পরিকল্পনা সাজানো হয়। যেটি সবচেয়ে বড় ভুল ছিল বলে মনে করছেন অনেকে। সেই সময়ে সাধারণ রোগীদের সেবা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলে এই হাসপাতালটি কোভিড (করোনাভাইরাস) চিকিৎসা দেওয়া থেকে বিরত ছিল।

তবে সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে এক হাজার ৩১৩ শয্যার এই হাসপাতালে একসময় নিয়মিত ধারণ ক্ষমতার কয়েকগুণ রোগী থাকলেও এই মুহূর্তে হাসপাতালটি অনেকটাই ফাঁকা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডে স্বাভাবিক সময়ে রোগী থাকে ২৫০ থেকে ৩০০ জন। কিন্তু বর্তমানে প্রতিটি ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি আছে মাত্র ৪০ জন থেকে ৬০ জন। এই চিত্র গত তিন মাস ধরেই।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের এক কর্মচারী বলেন, ‘যখন থেকে চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে গেছে, তখন থেকে রোগীর সংখ্যাও কমে গেছে। আগে বারান্দায় পর্যন্ত রোগী এসে গাদাগাদি করতো। কিন্তু এখন বারান্দা তো খালিই, ওয়ার্ডের ভেতরেও বেড খালি থাকে। এছাড়া রোগী আসলেও ডাক্তাররা তাদের ওষুধ লিখে দিয়ে ছেড়ে দেন। রোগীর অবস্থা একদম বেশি খারাপ হলে তাকেই ভর্তি নেয়। অন্যথায় নেয় না। এই এক কারণে রোগী কমেছে। আবার অনেকে করোনার ভয়ে হাসপাতালে আসে না। এ কারণেও রোগী কমে গেছে।’

ফলে অন্যান্য রোগীদের সেবার স্বার্থে করোনার চিকিৎসা পরিসর বাড়ানোর অনাগ্রহ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে। এই বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কোন পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমাদের এখানে বাড়ানোর কোন সুযোগ নেই। যে ভবনগুলোর কথা বলা হচ্ছে সেগুলোতে করতে হলে হার্টের চিকিৎসা বন্ধ করে দিতে হবে। চট্টগ্রামের হার্টের রোগীরা কোথায় যাবে? আমাদের এখানে পুরো চট্টগ্রামের রোগীরা চিকিৎসা নেয়। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর কথাও মাথায় রাখতে হবে। এখন যে ১৫০ শয্যা আমরা করোনার জন্য দিয়েছি এটা আমাদের হিসেবে এক্সট্রিম (বেশি) হয়ে গেছে।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here