তিন কর কর্মকর্তার প্রশ্রয়ে ৮ কোটি টাকা গেল টি কে গ্রুপের পকেটে

255

 

সরকারি নিয়ম ও অফিস আদেশকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান টি কে গ্রুপের কর্ণফুলী স্টিলস মিলসকে ৮ কোটি টাকার কর তড়িঘড়ি ফেরত দিয়েছে চট্টগ্রামের কর অঞ্চল-৩। এক্ষেত্রে কর অঞ্চল-৩ এর কমিশনার তার জারি করা অফিস আদেশ নিজেই ভেঙে করের টাকা ফেরত দেওয়ার প্রস্তাবে অনুমোদন দেন। এমনকি নিয়ম থাকলেও পূর্বানুমোদন নেওয়া হয়নি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডেরও। অন্যদিকে বিস্ময়করভাবে উচ্চ আদালতে আপিল করতেও অনীহা দেখিয়েছেন শীর্ষ কর কর্মকর্তারা। এর নেপথ্যে বড় অংকের আর্থিক লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কর অঞ্চল-৩ পরিদর্শী রেঞ্জ-১ এর অতিরিক্ত কর কমিশনার এবং সার্কেল-৪৬ (কোং) এর উপ কর কমিশনার গত ৩ নভেম্বর কর্ণফুলী স্টিলস মিলস লিমিটেডের ২০১২-১০২৩ বৎসরের কর প্রত্যর্পণ প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য কর কমিশনারের কাছে প্রস্তাব পাঠান। তিন দিনের মাথায়, ৬ নভেম্বর কর অঞ্চল-৩ এর কর কমিশনার মো. মাহবুবুর রহমান ওই প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়ে কর্ণফুলী স্টিলস মিলসের ২০১২-২০১৩ করবর্ষের আট কোটি ১৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬৫০ টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেন।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, টি কে গ্রুপের কর্ণফুলী স্টিলস মিলসকে সোয়া ৮ কোটি টাকারও বেশি কর উল্টো ফেরত দেওয়ার জন্য কর অঞ্চলের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা পদে পদে নিয়ম ভঙ্গ করেছেন। এমনকি কর কমিশনার নিজে তার জারি করা অফিস আদেশ নিজেই ভেঙে করের টাকা ফেরত দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করেছেন তড়িঘড়ি করে।

গত ১৫ অক্টোবর কর অঞ্চল-৩ এর কর কমিশনারের কার্যালয় থেকে জারি করা অফিস আদেশে কর নির্ধারণী আদেশ চূড়ান্তকরণে যেসব শর্ত অনুসরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তার ৮ নম্বরে আছে— ‘কর প্রত্যর্পণ সৃষ্টি/সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে উৎসে কর/অগ্রিম আয়কর ক্রেডিট দেওয়া হোক বা না হোক— পাঁচ লক্ষ টাকার উর্ধ্বে প্রত্যর্পণ সৃষ্টি হতে পারে সে ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করতে হবে।’

অথচ জানা গেছে, কর্ণফুলী স্টিলস মিলসের করের টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কোন অনুমোদনই নেওয়া হয়নি। এ প্রসঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (কর প্রশাসন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা) কালিপদ হালদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এই ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। আমার কাছে কর্ণফুলী স্টিলস মিলসের কর রিফান্ডের অনুমোদনও আসেনি এবং অফিস আদেশ ভঙ্গের ব্যাপারেও কেউ কোন অভিযোগ করেননি। তারপরও কর মেলা শেষে বিষয়টি আমি দেখবো।’

অন্যদিকে কর অঞ্চল-৩ চট্টগ্রামের কর কমিশনার মো. মাহবুবুর রহমান এ ব্যাপারে বলেন, ‘আইন মেনেই অনুমোদনে স্বাক্ষর করেছি। ওই কোম্পানির যাবতীয় আইনগত কার্যক্রম শেষ হয়ে গেছে। অনুমোদনের ক্ষেত্রে সব আইন মেনেই করা হয়েছে। আমার জানা মতে আইনভঙ্গের কোন কাজ হয়নি।’

জানা যায়, ২০১২-২০১৩ করব‌র্ষে মূল কর নির্ধারণী আ‌দে‌শের বিরু‌দ্ধে করদাতা চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান টি কে গ্রুপের কর্ণফুলী স্টিলস মিলসের প্র‌তি‌নিধি মোহাম্মদ আজম চট্টগ্রাম কর অঞ্চলের আপিল কর কমিশনারের কাছে আপিল করেন। এতে স্বল্পপরিমাণ কর কমানো হলে কর্ণফুলী স্টিলস মিলসের প্রতিনিধি কর ট্রাইবুন্যালে আপিল দায়ের করেন। অভিযোগ রয়েছে, সেখানে অস্বাভাবিকভাবে কর কমিয়ে দেওয়া হলেও এর প্রতিকার চেয়ে ইচ্ছাকৃতভাবেই উচ্চ আদালতে যাননি কর অঞ্চল-৩ সা‌র্কেল ৪৬ (কোম্পানিজ) এর সহকারী কর ক‌মিশনার একেএম মঈনউদ্দিন।

বিস্ময়করভাবে অভিযোগ পাওয়া গেছে, সাঁট মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর তোফায়েল আহমদ আইন শাখায় দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে উচ্চ আদালতে মামলা দায়েরে বিরত রাখার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। অ‌তি‌রিক্ত কর ক‌মিশনার হেমল দেওয়ান পুরো বিষয়টি মনিটরিং করেন।

তবে কর অঞ্চল-৩ চট্টগ্রামের পরিদর্শী রেঞ্জ-১ এর অতিরিক্ত কমিশনার হেমল দেওয়ান এ অভিযোগ অস্বীকার করে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা সরকারি কর্মকর্তা। আমাদের বিরুদ্ধে যদি কোন অভিযোগ থাকে, তাহলে উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ করেন। আমার কোন দোষ পেলে ওনারা সেটার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিশাল অংকের এই কর ফেরত দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদনে প্রায় দেড় কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে নেপথ্যে। এর মধ্যে পাঁচ পিয়ন ও চার কর্মচারী মিলে পেয়েছেন সাড়ে ২৬ লাখ টাকা। আর বাকি সোয়া এক কোটি টাকা ভাগ করে নিয়েছেন তিন কর্মকর্তা।

জানা গেছে, এরকম একাধিক কর্মকর্তা কয়েক যুগ ধরে আছেন একই কর্মস্থলে। আছে বিলাসবহুল হোটেল। অন্যদিকে কোন কোন কর কর্মচারীর আছে ১০ তলা বাড়ি। কেউ কেউ নগরীর বিভিন্ন জায়গায় খুলে বসেছেন নিজস্ব চেম্বারও। এমন একাধিক কর্মচারীর খোঁজ পাওয়া গেছে, যাদের বদলি আদেশ হলেও আগের কর্মস্থল থেকে নড়ানো যায় না।

সূত্র চট্টগ্রাম প্রতিদিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here