‘নতুন দিন, নতুন স্বপ্ন’-মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

389

 

সমকালের প্রধান প্রতিবেদক লোটন একরাম আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন। আমাকে প্রায়ই লিখতে বলে। আমি লেখক, প্রাবন্ধিক, কবি নই। নিরেট কাঠখোট্টা রাজনীতির মাঠকর্মী। হাজার মানুষের সঙ্গে উঠাবসা, রাজনীতির কঠিন আঙিনায় চলাফেরা, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে কোর্ট-জেলখানায় যাওয়া-আসা, জনসভা, মিছিলে বক্তব্য রাখা আমার কাজ। গত কয়েক বছরে সময় নিয়ে গান শোনা, ভালো ছবি দেখা, কবিতা অথবা উপন্যাস পড়া হয় খুব কম। আর লেখার অভ্যাসও গিয়েছে হারিয়ে।

এক সময় কবিতা আবৃত্তি করতাম। নাটকে অভিনয় করেছি নিয়মিত; ছবি দেখেছি, নাটক দেখেছি। যখন সুস্থ চিন্তা করাই কঠিন, সেই সময়ে সমকালের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ‘নতুন দিন, নতুন স্বপ্ন’ শিরোনামে লিখতে গিয়ে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের একটি কবিতার পঙ্‌ক্তি মনে পড়ল- ‘দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।/…বড় কথা বড় ভাব আসে না ক’ মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে!/ অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে!’

কয়েক দিন পরপর নিম্ন আদালতে যেতে হয় হাজিরা দিতে, পুরনো মামলায়। আর উচ্চ আদালতে যেতে হয় নতুন মামলার অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নিতে। এ রকম পরিস্থিতিতে নতুন স্বপ্ন দেখার সময় কোথায়! যখন অফিসে গিয়ে সালাহউদ্দিন সাহেবকে সর্বশেষ দলের নেতাকর্মীদের নামে মামলার সংখ্যা জিজ্ঞাসা করি, তিনি বলেন, ‘এক লাখের ওপরে… আসামির সংখ্যা ২৬ লাখ।’

যখন দেখি ২৬ বছর আগের মামলায় পাবনার ৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, আরও অনেকের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়, তখন কী স্বপ্ন দেখব? যখন দেখি, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় এফআইআরে নাম না থাকা তারেক রহমানের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, আব্দুস সালাম পিন্টুর মৃত্যুদণ্ড হয়; তখন কী স্বপ্ন দেখব! যখন দেখি আমাদের সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম, পারভেজসহ পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী নিখোঁজ; যাদের সাদা পোশাকের লোকেরা তুলে নিয়ে গেছে তাদের মা, স্ত্রী, সন্তানের সামনে দাঁড়াতে পারি না; তখন নতুন দিনের নতুন স্বপ্ন ফিকে হয়ে যায়।

যখন দেখি বিএনপির কর্মীরা গ্রামে থাকতে না পেরে ঢাকা এসে রিকশা চালাচ্ছে, ফেরিওয়ালা হয়েছে, বাড়িতে খাওয়ার টাকা নেই; তখন আর নতুন দিনের নতুন স্বপ্ন দেখার অবকাশ থাকে না। যখন দেখি শুধু রাজনীতি করার ‘অপরাধে’ বিএনপি কর্মীদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, জমি দখল হয়ে যায়; যখন দেখি মাস্টার্স, ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি পাস করেও বিসিএসে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও, বিএনপি করার ‘অপরাধে’ চাকরি হয় না; পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজনের কেউ বিএনপি করলে চাকরিতে প্রমোশন হয় না, তখন নতুন দিন অলীক বস্তুতে পরিণত হয়।

যখন দেখি ধর্মভীরু হওয়ায়, দাড়ি থাকলে জঙ্গি বলে তুলে নিয়ে যায়; স্বাধীন মতপ্রকাশের ‘অপরাধে’, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখির কারণে তুলে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন করা হয়, তখন আর নতুন দিনের কিংবা নতুন স্বপ্নের বাস্তবতা থাকে না।

সকালে খবরের কাগজ খুললে বা টিভির বোতাম টিপলে দুর্ঘটনায় মা-বাবা-সন্তানের মৃত্যু, অবুঝ শিশু ধর্ষণ, হত্যার খবরে শিউরে উঠি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হাইজ্যাক, বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটের খবর বেরোয় রোজ। উচ্চ আদালতে দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার প্রাপ্য জামিন যখন নাকচ হয়ে যায়, তখন নতুন দিনের কথা নতুন স্বপ্নের কথা ভাবা খুব কঠিন হয়ে যায়।

আবার যখন দেখি রোহিঙ্গা শিশুরা শরণার্থী শিবিরে লেখাপড়ার কোনো সুযোগ পায় না অথবা সিরিয়ার শিশুর লাশ ভূমধ্যসাগরের তীরে ভেসে থাকে, প্যালেস্টাইনে ইসরায়েলি বোমা বর্ষণে অসংখ্য শিশুর লাশ পড়ে থাকে; কাশ্মীরের শিশু-কিশোর-মেয়েরা রাজপথে নির্যাতনের শিকার হয়; যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলে অথবা নিউজিল্যান্ডের মসজিদে বন্দুক দিয়ে গুলিতে শত শত নিরীহ মুসলমান নাগরিক নিহত হয়, তখন নতুন দিন, নতুন স্বপ্ন কি দেখতে পাই?

আজকাল প্রায়ই মনে হয়, এ কেমন পৃথিবী আমরা দেখছি? যে পৃথিবীতে শক্তিশালীরা ক্ষমতার জোরে দুর্বলের ওপরে চড়াও হচ্ছে; আমাদের মতো ছোট ও তুলনামূলক দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে নিংড়ে নিচ্ছে উন্নয়ন সহায়কের ভেক ধরা ‘প্রতিবেশী আর বন্ধুরা’; যখন দেখি প্রতিবেশী আর বন্ধু থাকে না, তখন স্বপ্নরা উপহাস করে। তাই আমি তো স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাচ্ছি। নতুন দিন যে নতুন বার্তা নিয়ে আসবে- তার নিশ্চয়তা খুঁজে পাই না। প্রচণ্ড স্বার্থপরতা-ক্ষমতার লোভ বিশ্বকে, দেশকে, সমাজকে হিংসায় আচ্ছন্ন করে ফেলছে। ঘৃণা ছড়িয়ে দিচ্ছে দেশের বিরুদ্ধে, জাতির বিরুদ্ধে, ধর্মের বিরুদ্ধে, বর্ণের বিরুদ্ধে, বিশ্বাস ও মতের বিরুদ্ধে। এই হিংসা-ঘৃণা, নির্যাতন, হানাহানি, খুন-গুম, ধর্ষণ থেকে মুক্তি চাই।

এই মুক্তির জন্যই ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িয়েছিলাম। মুক্তির জন্যই শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। এই মুক্তির জন্য লাখ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে। এই মুক্তির জন্যই দেশনেত্রী খালেদা জিয়া আপসহীন; আপসহীন সংগ্রাম করেছেন, স্বামী-সন্তান হারিয়েছেন; নিজ বাড়ি থেকে উৎখাত হয়েছেন, দীর্ঘ ১৯ মাস কারাভোগ করছেন। এই মুক্তির জন্যই তারেক রহমান ১২ বছর নির্বাসিত হয়ে আছেন। আমরা সবাই সেই নতুন দিন দেখব বলে, নতুন স্বপ্ন দেখব বলে নিরন্তর সংগ্রাম করে চলেছি। বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাবরণ করেছে। শত শত নেতাকর্মী নিখোঁজ হয়েছে; নিহত হয়েছে শত শত।

মুক্ত বাংলাদেশ, মুক্ত বিশ্ব দেখতে চাই। স্বাধীন-সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, লড়াই করি। নতুন দিনে সেই স্বপ্ন সত্য হবে। আগের রাতে ভোটে নয়; জনগণের ভোটে সরকার ও সংসদ নির্বাচিত হবে। মানুষ তার ভোটের অধিকার বিনা বাধায় প্রয়োগ করতে পারবে, পাতানো নির্বাচনের প্রহসনের নাটক হবে না- এমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি।

এমন একটি বাংলাদেশ দেখতে চাই, যেখানে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হবে। দেখতে চাই দুর্নীতি একেবারেই দূর হয়েছে। ক্ষমতার রাজনীতিতে বলীয়ানরা শতকোটি টাকা কামাচ্ছে ক্যাসিনো বসিয়ে, হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছে- এমন দুঃস্বপ্নের বাংলাদেশ আমরা চাই না। আমি স্বপ্ন দেখি, সব শিশু ও মেয়ে নিরাপদ থাকবে, নিরাপদ সড়ক থাকবে, কৃষক ধানের দাম পাবে, গার্মেন্টস শ্রমিক ও অন্যান্য শ্রমিক তাদের শ্রমের দাম পাবে, নির্ভয়ে মুক্তহস্তে লিখতে পারবেন সাংবাদিকরা। দেখতে চাই নতুন দিনে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইছে।

আজ দিন যতই কালো হোক, কাল নতুন দিনে নতুন আলো ছড়াবেই। বাংলাদেশের সবুজ প্রান্তরে সোনালি দিনের আলো উদ্ভাসিত হবেই। নতুন স্বপ্ন নিয়ে নতুন দিন আসবেই।

লেখকঃ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)

( দৈনিক সমকালের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে লেখা)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here