নিজেদের যেন হারিয়ে না ফেলি

226

 

আব্দুল্লাহ আল নোমান

চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে যাত্রারম্ভ করে করোনা ভাইরাস এখন পুরো পৃথিবীর বুকে দম্ভভরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। চলার পথে সে বিপর্যস্ত করেছে অনেক শহর এবং জনপদ। প্রথম দিকে চীনে ব্যাপক হারে মানুষের মৃত্যু হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এখন তা একেবারে কমে এসেছে। কিন্তু প্রাণঘাতী এই ভাইরাসকে চীনের বুকেই দাফন করা সম্ভব হয়নি। সেটা এখন পৃথিবীর প্রায় সবকটি অঞ্চলেই ছড়িয়ে পড়েছে। করোনা ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হয়েছে ইউরোপ। সেখানে মানুষ অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করছে এবং প্রতিদিন সেখানে হাজার হাজার মানুষের জীবনাবসান হচ্ছে। বেঁচে থাকার জন্য মানুষের আকুতি আমাদের হৃদয় ছুঁয়েছে। আমরা তাদের জন্য অসহায়ের মতো শুধু ক্রন্দন করতেই পারছি। পুরো পৃথিবী এখানে এসে যেন এক বিন্দুতে মিলিত হয়েছে।

ইতোমধ্যে করোনা ভাইরাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে,ইউরোপের ন্যায় বাংলাদেশেও ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিন সেখানে হাজার হাজার নতুন রোগী শনাক্ত করা হচ্ছে এবং মৃতের সংখ্যাও নেহায়েত সামান্য নয়। বাংলাদেশেও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণের সংখ্যা বেড়েই চলছে। খোদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে এই সময় পর্যন্ত দেশের স্বাস্থ্য সেবায় অনন্য অবদান রাখা বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা: জাফর উল্লাহ চৌধুরী ও বাংলাদেশের স্বাস্থমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম করোনায় আক্রান্ত হয়ে বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি। শুধু তারা নন, বিশ্বের অনেক বড় বড় তারকাও ইতোমধ্যে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। সুতরাং করোনা যে কাউকেই ছেড়ে কথা কইবে না সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এতসব ঘটনার মধ্যেও আমরা সবচেয়ে বেশি শঙ্কিত আছি প্রিয় মাতৃভূমিকে নিয়ে। চীন এবং ইরান ব্যতিত এশিয়ার আর কোনো দেশে করোনা ভয়ঙ্কর রূপে দেখা না দিলেও বাংলাদেশের জন্য এখনও পুরোমাত্রায় ভয়ের কারণ রয়েছে। ইতোমধ্যে এখানে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক হাজার’ এবং তাদের মধ্যে মৃত্যুবরণ সংখ্যা হাজারের কাছাকাছি।। সুতরাং চীন, ইরান, ইতালি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্রে কাঁপন ধরানো এই ভাইরাস এখন আমাদের একেবারে দোরগোড়ায় এসে উপস্থিত হয়েছে।

মানুষ থেকে মানুষে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাসকে প্রতিরোধ করার মতো কোনো শক্তি আমরা এখনও অর্জন করতে পারিনি। বিশ্বের বাঘা বাঘা চিকিৎসাবিজ্ঞানী ইতোমধ্যে এই ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য নিজেদের নিয়োজিত করেছেন। কবে নাগাদ তারা সেটি করতে পারবেন তা সুস্পষ্ট নয়। তবে ততদিন এই ভাইরাসের মোকাবেলা আমাদের করতে হবে। আমরা যদি হাল ছেড়ে দিই এবং নিজেদের আত্মবিশ্বাসকে পুরোপুরি হারিয়ে ফেলি, তাহলে করোনা আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণ করবে। সুতরাং আমাদের আরও সচেতন থাকতে হবে। ডাক্তাররা করোনা প্রতিরোধের জন্য যে সমস্ত নির্দেশনা দিয়েছেন সেগুলো পুরোমাত্রায় মেনে চলতে হবে।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো আমাদের দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা ততটা উন্নত নয়। হাসপাতাল গুলোতে অব্যবস্থাপনার ছড়াছড়ি দেখে আমরা রীতিমতো হতাশ হই। দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ার পর এই অব্যবস্থাপনা যেন বহুগুণ বেড়ে গেছে। তাছাড়া এদেশের মানুষ একেবারে সচেতন নয় এবং কোনো নিয়মনীতি মানার ব্যাপারে তাদের প্রবল অনীহা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনার ব্যাপকতা ঠেকাতে বেশকিছু জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হওয়া যাবে না এবং কোনো স্থানে জনসমাগম করা যাবে না। কিন্তু আমরা খেয়াল করে দেখেছি, মানুষ একেবারেই এসব মানতে চাচ্ছে না। ফলে দ্রুত ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। এছাড়া গার্মেন্টস সেক্টরে যে নজিরবিহীন অব্যবস্থাপনা প্রত্যক্ষ করেছি, তা দেশের বিবেকবান মানুষকে রীতিমতো ক্ষুব্ধ করেছে।
করোনা সংক্রমণের পর পৃথিবীর বহু দেশ তাদের শিক্ষা কার্যক্রম বেশ কয়েক মাসের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে। আমাদের দেশও প্রথম দিকে দুই মাসের জন্য বন্ধ ঘোষণা করলেও এখন খুলে দেওয়া হয়েছে।। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এমনিতেই বহু প্রশ্ন রয়েছে। শিক্ষার মান নিয়েও রয়েছে নানামুখী সংশয় ও সন্দেহ। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ থাকার ফলে এখানে নিঃসন্দেহে একটা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। আর আমরা এই বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি শঙ্কিত হয়ে পড়ছি।

বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে বাড়িতে এসেছি ২মাসেরও বেশি হতে চলল। সারাদিন বাড়িতেই থাকি। মাঝে-মধ্যে গাছতলায় ঠান্ডা কোথাও গিয়ে বসি। কয়েকদিন আগে খেয়াল করে দেখলাম, বাড়ির পাশেই এইরকম গাছের ছায়ায় উঠতি বয়সী কিশোরদের আড্ডা। কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, তারা সবাই সেখানে একধ্যানে মোবাইলে গেমস খেলছে; দুনিয়ার কোনো দিকেই তাদের কোনো খেয়াল নেই। পরপর কয়েকদিন ভালোমতো খেয়াল করে দেখেছি, প্রতিদিন তারা প্রায় সারাদিন সেখানে বসে গেমস খেলে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, গেমস তারা আগেও খেলত। তবে স্কুল চলাকালীন তারা তেমন সুবিধা করে উঠতে পারেনি। করোনা এসে তাদের পুরো দিন গেমসের পেছনে কাটানোর সময় করে দিয়েছে। কয়েকবার তাদের বোঝানোর চেষ্টা করে বুঝলাম, এরা একেবারেই বোঝার বান্দা নয়।

এভাবে যদি দীর্ঘদিন স্কুল ছুটি থাকে তাহলে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা কার্যক্রম থেকে অনেকটা দূরে সরে যাবে। অনেকেই আবার এমন কিছুর সঙ্গেও জড়িত হয়ে পড়তে পারে, যা তার নিজের এবং দেশের জন্য অমঙ্গল বয়ে আনতে পারে। আমাদের দেশের অধিকাংশ পিতামাতা সন্তানকে পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য কোনো বই-হোক সেটা গল্প, কবিতা, ইতিহাস কিংবা পত্রিকা পড়তে দিতে একেবারে নারাজ। অনেককে দেখেছি এসব বইয়ের প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করতে। কিন্তু সেটা মোটেও বাস্তবসম্মত কোনো কাজ নয়। অভিভাবকদের অনুরোধ করব, আপনার সন্তানকে বিভিন্ন ধরনের বই ও পত্রিকার প্রতি আগ্রহী করে তুলুন। বই-পত্রিকা হলো মনের দরজা। যে যত বেশি বই-পত্রিকা পড়বে তার মনে ততবেশি জ্ঞানের দরজা উন্মোচিত হয়ে পড়বে। আর একবার যদি আপনার সন্তান বই-পত্রিকার জগতে প্রবেশ করতে পারে, তাহলে তাকে নিয়ে আর মোটেও দুশ্চিন্তা করা লাগবে না।

চাকরিজীবী পিতামাতা অনেক সময় সন্তানকে সময় দিতে পারেন না। এতে করে সন্তান যেমন তাদের নিবিড় স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয় তেমনি তার ভবিষৎতও একটা অনিশ্চয়তার গর্ভে আবর্তিত হতে থাকে। এখন যেহেতু সকল চাকরীর পরবর্তী সময় বাসায় অবস্থান করছেন তাই সন্তানের সঙ্গে বেশি বেশি সময় কাটান। তাদের সঙ্গে আলোচনা করুন নানান প্রসঙ্গ নিয়ে। তাদের ভেতর মানবিক মূল্যবোধের একটা সোপান গড়ে তুলুন। হয়ত এই সময়টা তাদের জন্য একটা আশীর্বাদ হয়ে আসতে পারে।

করোনা ভাইরাস এখন দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। আগামী কয়েকদিনে সেটা আরও ভয়াবহ অবস্থা ধারণ করতে পারে বলে মনে হচ্ছে। এই অবস্থায় আমাদের সকলকে জাতির মঙ্গলের কথা চিন্তা করে কাজ করতে হবে। কোনোরূপ ব্যক্তিস্বার্থ কিংবা ক্ষুদ্রস্বার্থ যেন আমাদের ভেতর অনুপ্রবেশ করতে না পারে। পত্রিকার পাতায় দেখা বেশ কয়েকটি সংবাদ মর্মাহত করেছে। এদেশের একেবারে প্রান্তিক জনগণের সাহায্যের জন্য যে সমস্ত ত্রাণের চাল পাঠানো হয়েছিল সেটা আমাদের মহান (!) নেতারা নিয়ে নিজেদের ঘরে ঢুকিয়ে রেখেছেন। এরকম বেশ কয়েকজন নেতা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন। প্রিয় নেতাগণ, দেশের এমন সংকটজনক অবস্থায় জাতির সঙ্গে এরূপ বেঈমানি করবেন না। প্রতিদিন আমাদের কানে মৃত ব্যক্তির পরিবার থেকে ভেসে আসা হাহাকার হৃদয়ে এসে তীক্ষè তীরের মতো আঘাত করে। সকলের ব্যথায় আমরা ব্যথিত হই। আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে; রয়েছে অনেক কিছুর সংকট। হাসপাতালগুলো চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে ধুঁকছে। ডাক্তার এবং নার্সদের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীরও যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। তবুও তারা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এমনকি কয়েকজন ডাক্তারও করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেছেন। এই অবস্থায় আমাদের মানসিকভাবে শক্ত হতে হবে। করোনা এসেছে; তার প্রভাব শেষ হলে একদিন বিদায়ও নেবে। তবে আমাদের ভেঙে পড়লে চলবে না কিছুতেই। নিজেদের যেন হারিয়ে যেতে না দিই। ঘরে বসে বসে হলেও দেশ ও জাতিকে গঠনের জন্য নিজেদের সাধ্যমতো কাজ করে যাই।

লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক ,ছাত্রদল,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ই-মেইল: aanoman29@gmail.com মোবাইল নং :-01815161931.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here