পদে পদে প্রতিকূলতার মুখে প্রবাসীরা অনেকের আবার যাওয়া অনিশ্চিত

293

 

শুধু কোভিড নেগেটিভ সনদই নয়, আরো নানা সংকটে চট্টগ্রামে আটকে পড়া লক্ষাধিক প্রবাসীর জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠতে শুরু করেছে। জীবিকা নিয়েও শংকিত অনেকেই। নানা ভোগান্তি সয়েও রেমিটেন্স যোদ্ধারা বিদেশ যেতে মরিয়া। কিন্তু বিশ্বের নানা দেশে নিত্য সংকটে এদের শেষতক বিদেশ যাওয়া হবে কিনা তা নিয়েও শংকিত অনেকেই। ২৫ হাজার টাকা দামের টিকিট এক লাখ টাকা দিয়েও জোটানো কষ্ট হচ্ছে। আবার চড়া দামে কেনা টিকিট কোভিড সনদের জন্য ঝুলে যাচ্ছে। এই ঝোলাঝুলির মধ্যে বাংলাদেশ বিমানের টাকা ফেরত পাওয়া গেলেও বাজেট এয়ারের টাকা মার যাচ্ছে। সবকিছু মিলে রেমিটেন্স যোদ্ধাদের অবস্থা ক্রমে নাজুক হয়ে উঠছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, বিশ্বের নানা দেশে এক কোটিরও বেশি প্রবাসী বসবাস করেন। এরমধ্যে চট্টগ্রামে প্রবাসীর সংখ্যা পণের লাখেরও বেশি। দেশে চট্টগ্রামেই সবচেয়ে বেশি প্রবাসীর বসবাস। চট্টগ্রামের বিপুল সংখ্যক প্রবাসীর মধ্যে কোভিড পরিস্থিতির আগে নানা কারণে দেশে আসেন লক্ষাধিক মানুষ। যারা ছুটি-ছাঁটা কাটিয়ে আবারো ফিরে গিয়ে কাজে যোগ দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোভিড পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করায় এরা দেশে আটকা পড়েন। নানাভাবে সংকটে পড়া এই লক্ষাধিক বিদেশি এখন পুনরায় কাজে ফিরতে মরিয়া। কিন্তু তাদের বিদেশ যাত্রার ব্যাপারটি পদে পদে নানা প্রতিকূলতার শিকার হচ্ছে। অনেক প্রবাসীই আর ফিরতে পারছেন না। অনেক প্রবাসীর আর যাওয়ার কোন পথই নেই।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কোভিড পরিস্থিতির আগে দেশে আসা প্রবাসীদের অনেকেরই এক থেকে তিন মাস পর্যন্ত ছুটি ছিল। ইতোমধ্যে সেই সময় পার হয়ে গেছে। আবার ভিসার মেয়াদ ফুরিয়েছে বহু প্রবাসীর। অনেককে আবার মালিকপক্ষ আর কাজে নিতে চাচ্ছেন না। কারো কারো আবার কাজে যোগ দেয়ার সুযোগ থাকলেও টিকিটের অভাবে যেতে পারছেন না। কারো কারো টিকিট জুটলেও অনাপত্তি জুটছে না। জুটানো কষ্ট হয়ে যাচ্ছে কোভিড নেগেটিভ সনদ। কেউ কেউ ইতোমধ্যে কোভিডে আক্রান্তও হয়েছেন। করোনা পরীক্ষা করাতে এসেও কেউ কেউ পেয়েছেন কোভিড পজেটিভ সার্টিফিকেট। এতে করে চড়াদামে টিকিট করেও বিদেশ যাত্রা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে অনেকের। আড়াই থেকে চারগুণ দামে কেনা টিকিট বাতিল করতে হচ্ছে অনেককে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, কোভিড সনদই একটি কঠিন পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে চট্টগ্রামের প্রবাসীদের জন্য। বিদেশ যাত্রার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে কোভিড সনদ নেয়ার বাধ্যবাধকতায় দিশেহারা চট্টগ্রামে অবস্থানরত প্রবাসীরা। শত শত প্রবাসীকে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় এবং জেনারেল হাসপাতালে এসে ভিড় করতে হচ্ছে কোভিড পরীক্ষার জন্য। এই কোভিড পরীক্ষার আগেই ভিসার ব্যাপারটি ঠিকঠাক করতে হচ্ছে। কনফার্ম করতে হচ্ছে টিকিট। ভিসা এবং টিকিট দেখিয়ে সাড়ে তিন হাজার টাকা জমা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হচ্ছে। সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে রেজিস্ট্রেশনের পর যেতে হচ্ছে জেনারেল হাসপাতালে। ওখানে নমুনা দিয়ে একদিন পরে পাওয়া যাচ্ছে রিপোর্ট। ওই রিপোর্টে নেগেটিভ হলেই কেবলমাত্র বিদেশ যাত্রা সম্ভব হচ্ছে। করোনা পজেটিভ হলে ওই ব্যক্তির পক্ষে বিদেশ যাত্রা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু আগে থেকে করা টিকিটের টাকা মার যাচ্ছে। বাংলাদেশ বিমানের ক্ষেত্রে কিছু টাকা লোকসান দিয়ে টিকিটের ডেট পরিবর্তন কিংবা টিকিট বাতিল করে টাকা ফেরত নেয়ার সুযোগ থাকলেও বিদেশি বাজেট এয়ারগুলোর ক্ষেত্রে এই সুযোগ থাকে না। এতে করে চড়া দামে টিকিট কিনে করোনা পজেটিভ হয়ে কেউ কেউ আর বিদেশ যেতে পারছেন না।
একটি ট্রাভেল এজেন্সির শীর্ষ একজন কর্মকর্তার সাথে আলাপকালে বলেন, দুবাই কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে একটু সময় নিয়ে টিকিট করলে আসা-যাওয়ার টিকিটই পাওয়া যেত ২৫/৩০ হাজার টাকায়। এখন শুধু যাওয়ার টিকিটই কিনতে হচ্ছে ক্ষেত্রবিশেষে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকায়। চড়া দামে কেউ কেউ বিদেশ গেলেও অনেকে যেতেই পারছেন না।
বিমানের টিকেটের পাশাপাশি বিশ্বের নানা দেশের ভিসা নিয়েও চলছে নানা সংকট। করোনা পরিস্থিতিতে ধসে পড়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বহু দেশই নিজেদের কাজকর্ম নিজেদের লোক দিয়ে করানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে হাজার হাজার প্রবাসী শ্রমিক কর্মচারী চাকরিও হারাচ্ছেন। দেশে এসে আটকা পড়া অনেকেই এই সংকটে ইতোমধ্যে চাকরি হারিয়ে চোখে মুখে অন্ধকার দেখছেন।
সীতাকুণ্ডের সৈয়দপুর এলাকার কামরুল ইসলাম আর কখনো বিদেশ যেতে পারবেন কিনা বুঝতে পারছেন না। তার ভিসা থাকলেও সেখানে ছুটির যেই মেয়াদ দেয়া হয়েছিল তা শেষ হয়ে গেছে। এখন তিনি চড়াদামে টিকিট কিনে গেলেও বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন তাকে সেই দেশে ঢুকতে দেবে কিনা তা তিনি বুঝতে পারছেন না। এই ব্যাপারে ট্রাভেল এজেন্সির দুয়ারে দুয়ারে ধর্ণা দিয়েও তিনি কোন সদুত্তর পাননি। বাহরাইনে তার টিকিটের দাম চাওয়া হয়েছে আড়াই লাখ টাকা। এত টাকাও তার কাছে নেই। আবার এত টাকা খরচ করে বিদেশ গিয়ে আদৌ কোনো লাভ হবে কিনা তা নিয়ে দুঃচিন্তায় রয়েছেন কামরুল।
আলাপকালে কামরুল জানান, দেশেও কোনো কাজ নেই। কিছু করার নেই। পরিবার পরিজন নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো বুঝতে পারছি না।
শুধু কামরুল একজন নন, এই ধরনের হাজার হাজার প্রবাসী চট্টগ্রামের নগর বন্দর গ্রামে এখন চোখে মুখে অন্ধকার দেখছেন। তারা বিষয়টি নিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কূটনৈতিক তৎপরতা দরকার বলেও মন্তব্য করেছেন। তারা বলেন, একমুখী সংকট হলে মানুষ সামাল দিতে পারেন। কিন্তু এতমুখী সংকট মোকাবেলা কঠিন। এত সংকটে পড়ে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন বলেও তারা মন্তব্য করেছেন।
বিষয়টি নিয়ে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. মইনুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘রেমিটেন্স যোদ্ধাদের অবস্থা খুবই নাজুক। যারা দেশে এসে আটকা পড়েছেন তাদের অবস্থা যেমন খারাপ। তেমনি বিদেশেও প্রচুর প্রবাসীর অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। তাদের অনেকেরই চাকরি নেই। অনেকের কোনো কাজ নেই। খাবারের অভাবে রয়েছেন অনেকে। তারা না পারছেন কাজ করতে। না পারছেন দেশে ফেরত আসতে। বিমান ভাড়া যোগাড় করতে না পেরে বহু প্রবাসী আটকা পড়ে আছেন। বিমানের ভাড়া এদিক থেকে যাওয়ার সময় যেমন বেড়েছে তেমনি ওদিক থেকে আসার ভাড়াও বেড়েছে।’
তিনি মধ্যপ্রাচ্যসহ বহু দেশ থেকেই কয়েক লাখ প্রবাসী ফেরত আসবেন বলে উল্লেখ করে বলেন, এই বিপুল সংখ্যক রেমিটেন্স যোদ্ধার ফিরে আসা শুধু অর্থনীতিই নয়, দেশের সার্বিক অবস্থার উপরই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়ের চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক জহিরুল আলম মজুমদার বলেন চট্টগ্রামে অন্তত ১৫ লাখ প্রবাসী থাকার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে প্রবাসীর সংখ্যা অনেক বেশি। তবে এই সংখ্যা কত তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান তাদের কাছে নেই।

#সূত্র দৈনিক আজাদী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here