নিউজ ডেস্ক..
চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে মৃত্যুঝুঁকিতে বসবাস করছে সহস্রাধিক পরিবার। প্রশাসনের আলটিমেটাম, বার বার উচ্ছেদ করার হুমকি এবং ম্যাজিস্ট্রেটের অভিযানে একাধিক দফায় উচ্ছেদ করার পরও ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরানো যাচ্ছে না।
এরই মধ্যে শনিবার রাতে নগরীর দুটি এলাকায় দেয়াল ও পাহাড় ধসে একই পরিবারের তিন জনসহ চার জন নিহত হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করে সতর্ক করার পাশাপাশি বার বার উচ্ছেদ করা হলেও পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের টনক নড়ছে না।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন জানান, পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের বার বার সরে যেতে গত এক সপ্তাহ ধরে মাইকিং করে সতর্ক করা হচ্ছিল। এর পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে নগরীর কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি এলাকা থেকে অধিবাসীদের সরিয়ে নেওয়া হয়।
কিন্তু বৃষ্টি কমলে এবং রোদের দেখা পেলে তারা আবার ওইসব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাস শুরু করে। এর ফলে পাহাড় ধসে প্রাণহানি ঘটছে জানান জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন।
প্রায় প্রতি বছরই প্রবল বর্ষণ কিংবা বর্ষা মৌসুমে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় ধসে প্রাণহানি ঘটে। বার বার প্রাণহানি এবং প্রশাসনের সতর্কতা সত্ত্বেও পাহাড়ের পাদদেশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাসকারীদের সরিয়ে আনা যাচ্ছে না।
বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় ১৩টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে সহস্রাধিক পরিবার মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে।
গত কয়েক দিনে ঘূর্ণিঝড় তিতলির প্রভাবে বর্ষণ শুরু হলে চট্টগ্রামে পাহাড় ধসের আশঙ্কায় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের নিরাপদ এলাকায় সরে যেতে বলা হলেও অধিকাংশই ঝুঁকিপূর্ণ আবাস ছেড়ে যায়নি।
এই মধ্যে শনিবার রাতে প্রবল বর্ষণে নগরীর রহমান নগরে দেয়াল ধসে একজন এবং আকবর শাহ থানার ফিরোজশাহ কলোনী এলাকায় পাহাড় ধসে একই পরিবারের তিন জন নিহত হয়।
বাংলাদেশে পাহাড় ধসে প্রাণহানিকে আর্থ-সামাজিক, পরিবেশগত এবং রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করছেন একজন বিশেষজ্ঞ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল এবং পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. শহীদুল ইসলাম পাহাড় ধসের কারণ নির্ণয় বিষয়ক সম্প্রতি গঠিত কারিগরি কমিটির একজন সদস্য এবং এর আগে ২০০৭ সালেও একইধরনের একটি কমিটির হয়ে তিনি এনিয়ে গবেষণা করেছিলেন।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক স্বদিচ্ছার মাধ্যমেই এর সমাধান করতে হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়গুলো বালুময় পাহাড় এবং এসব পাহাড়ের ভেতরে অনেক ফাটল থাকায় অতিবৃষ্টির ফলে প্রাকৃতিকভাবেই “পাহাড়ের ফাটলে পানি ঢুকে ধস হতে পারে”।
দ্বিতীয় কারণটি মানবসৃষ্ট, অবৈধভাবে প্রচুর পরিমাণ পাহাড় কাটার ফলে পাহাড় ধস হচ্ছে এবং পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী অনেকে মারা যাচ্ছেন।
সম্প্রতি প্রকাশিত দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের কমপ্রিহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট পারফরমেন্সের (সিডিএমপি) এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, শুধু বর্ষণের কারণে নয়, ভূমিকম্পেও চট্টগ্রামে পাহাড় ধসের ব্যাপক জানমালের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
রিপোর্টে বলা হয়, চট্টগ্রাম মহানগর এবং সংলগ্ন এলাকার পাহাড়গুলোর মধ্যে ১৩টি পাহাড় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। পাহাড়গুলো হচ্ছে- বাটালি হিল, টাইগারপাস ইন্ট্রাকো সংলগ্ন পাহাড়, বিআইটি আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়, ইস্পাহানি পাহাড়, শেরশাহ মীর পাহাড়, একে খান পাহাড়, টাইগারপাস জেলা পরিষদ পাহাড়, লেকসিটি আবাসিক এলাকার সংলগ্ন পাহাড়, সিডিএ অ্যাভিনিউ পাহাড়, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট পাহাড়, চটেশ্বরী জেমস ফিনলে পাহাড়, কৈবইল্যাধাম পাহাড় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পাহাড়।
এসব পাহাড়ে বালির পরিমাণ বেশি। বৃষ্টির সময় বালিতে পানি ঢুকে নরম হওয়ার পর ধসে পড়ে। বৃষ্টি ছাড়া ভূমিকম্পে যে কোনো মুহূর্তে পাহাড়গুলো ধসে পড়তে পারে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোর মধ্যে প্রতিটি পাহাড়ে গড়ে দেড়শত থেকে দুইশত পরিবার বসবাস করে থাকে। পাহাড়ের গা ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা।
এ সব স্থাপনায় রয়েছে অবৈধ বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ। দুর্যোগ দেখা দিলে এসব পাহাড়ে উদ্ধার তৎপরতা পরিচালনা অসম্ভব হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায়। বিশেষ করে রাতে পাহাড় ধসে পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার শুরু করা যায় না বলে প্রাণহানি বেশি ঘটে।
পাশাপাশি বিভিন্ন মালামাল রক্ষা করার তেমন সুযোগ না থাকায় চট্টগ্রামে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় ধসে প্রাণহানির পাশাপাশি ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে।
২০০৭ সালে চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে ১২৭ জন মানুষ মারা যায়। এর ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালের জুন মাসে বাটালি হিলে আবার পাহাড় ধসে ১৭ জনকে প্রাণ দিতে হয়েছে।
কিন্তু পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসতিগুলো থেকে মানুষকে সরানো যায় না কেন?
অধ্যাপক ইসলামের মতে, এর পুরো কারণটিই আর্থ-সামাজিক।
ছিন্নমূল এসব মানুষদের কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকায় তারা কম খরচে এসব ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাতেই বসবাস করছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানীয় এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে এ ঘরগুলো তৈরি করেন।
“যেহেতু এটার সাথে একটি গভীর আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রসেস জড়িত, সেজন্যে চাইলেও তাদের সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া যাচ্ছে না” বলেন অধ্যাপক ইসলাম।
পার্বত্য জেলাগুলো, চট্টগ্রাম জেলা, এমনকি শহরেও পাহাড় ঘেষে তৈরি করা অনেক বসতি রয়েছে ঝুঁকিতে।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের এক কর্মকর্তা বলছেন, তারা ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদের কাজ শুরু করেছেন এবং তারা জরিপ চালিয়ে দেখেছেন এসব বসতির অধিকাংশই অবৈধ।
তবে তিনিও বলেন, ঝুঁকির কারণে অনেকে সাময়িকভাবে এসব জায়গা থেকে সরে গেলেও ফিরে এসে আবার সেখানেই বসতি করেন।
এর আগেও অনেকবার পাহাড়ধসের ঘটনার পর উচ্ছেদসহ নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু এধরণের ঘটনা ঘটে চলছে প্রায় প্রতিবছর। একদিকে পাহাড় কেটে চলছে বসতি নির্মাণ এবং অপরদিকে পাহাড়ধসে মানুষের মৃত্যু।
অধ্যাপক ইসলাম বলেন, বড় সংখ্যায় হতাহতের ঘটনা ঘটলেই নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে নড়াচড়া হয়, কিন্তু পরে অনেকক্ষেত্রেই তা স্তিমিত হয়ে যায়।
২০০৭ সালে পাহাড় ধসে ১২৭ জনের মৃত্যুর পর এনিয়ে সরকারীভাবে নানা উদ্যোগের কথা বলা হয়েছিল।
“এরপরের বছরগুলোতে পাহাড় ধস হয়েছে, কিন্তু মৃত্যুর পরিমাণ ছিল কম। ফলে বিষয়টিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি”।
পাহাড় রক্ষা এবং ঝুঁকিতে থাকা এসব মানুষদের বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে বর্তমান কমিটিটি কাজ করছে ত্রাণ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে ।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক রিয়াজ আহমেদ বলছিলেন, এই কমিটির বিশেষজ্ঞ প্রতিবেদন চূড়ান্ত হবার পর স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদী তিন ধাপে তারা এনিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা করেছেন। যার মধ্যে কিছু পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও থাকতে পারে।