বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ঈদ কাটছে কারাগারে। দলীয় প্রধানের অনুপস্থিতিতে তাই নেই বাড়তি কোনো আয়োজন। ঈদের দিন সিনিয়র নেতারা দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মাজার জিয়ারত করে যাবেন রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে, যেখানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বেগম জিয়া। ঈদ উপলক্ষে বেগম জিয়ার সাক্ষাৎ চেয়ে ইতোমধ্যে চিঠি দিয়েছে বিএনপি। পরিবারের সদস্যরাও ঈদের দিন তার সাথে দেখা করতে চান।
বেগম জিয়ার পরিবারের একজন সদস্য গত বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেছেন, কারা কর্তৃপক্ষ গত বছর দীর্ঘ সময় বসিয়ে রাখার পর তাদের সাক্ষাতের অনুমতি দিয়েছিল। ফলে বেগম জিয়ার জন্য রান্না করে নিয়ে যাওয়া খাবার খাওয়াতে পারেননি। কারণ বিলম্বের কারণে খাবার নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ওই সদস্য আরো জানান, এবার শবেকদর উপলক্ষে পরিবারের সদস্যরা দেখা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু অনুমতি দেয়া হয়নি।
বেগম জিয়ার সাথে পরিবারের সদস্যদের নিয়মিত বিরতিতে সাক্ষাৎ করতে দেয়া হয় না বলে বিএনপির প্রায়ই অভিযোগ শোনা যায়। দলটি এবার তাদের নেত্রীর শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। বেগম জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ে বিএনপি সর্বশেষ উদ্বেগ জানিয়ে বলেছে, অস্বাভাবিক মানসিক চাপে খালেদা জিয়ার আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণ বেড়েছে। মারাত্মক জীবনবিনাশী জীবাণু দ্বারা ফুসফুসের সংক্রমণ বা নিউমোনিয়ার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া কারাগারে থাকার সময় সেখানকার পরিবেশের জন্য ভয়ঙ্কর মাত্রার ভিটামিন-ডি ও ক্যালসিয়াম-শূন্যতা দেখা দিয়েছে, যা তার হাড়ের জন্য মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। তিনি দুই হাতেই এখন নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগ করছেন।
বিএনপি বলেছে, বেগম জিয়ার সর্বশেষ স্বাস্থ্য পরীক্ষায় জানা গেছে, ইনসুলিন ব্যবহারের পরও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ তো হচ্ছেই না, বরং তা বিপজ্জনক মাত্রায় অবস্থান করছে। ইতোমধ্যে তার মুখে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, এই ক্ষতের জন্য মুখে প্রচণ্ড ব্যথার সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে তিনি স্বাভাবিক খাওয়া-দাওয়া করতে পারছেন না, কোনোরকমে জাউ খেয়ে জীবন ধারণ করছেন।
যদিও বিএসএমএমইউর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা: এ কে মাহবুবুল হক জানিয়েছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন গ্র্যাজুয়ালি ইম্প্রুভিং। তার যে সমস্যাগুলো রয়েছে সেগুলো ক্রনিক ডিজিস, এগুলো একটু সময় লাগে, খুব স্লো ইম্প্রুভ হয়। ডায়াবেটিস, আরথ্রাইটিসসহ অন্যান্য যে দুর্বলতা ছিল- সেগুলোর উন্নতি হচ্ছে।
খালেদা জিয়া এক বছরের অধিক অর্থাৎ ৪৭৭ দিন ধরে কারাবন্দী রয়েছেন। এবারের ঈদ ছাড়াও আরো চারটি ঈদ কারাগারে কেটেছে খালেদা জিয়ার। এক-এগারোর সময় দুই ঈদ কাটিয়েছেন তিনি কারাগারে। গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দী হওয়ার পর দুই ঈদ জেলখানায় কাটান তিনি।
জানা গেছে, নিয়মিত রোজা রেখেছেন বেগম জিয়া। কারাবিধি অনুযায়ী ত্রিশ টাকা সমপরিমাণে ইফতার সামগ্রী পেয়েছেন তিনি। বাইরে থেকে কোনো খাবারসামগ্রী নিতে দেয়া হয়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের খাবারই তাকে খেতে হয়েছে।
আইনজীবীদের ভাষ্যানুযায়ী, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে থাকা ৩৬ মামলার মধ্যে চারটি মামলা তার মুক্তিতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে দণ্ডিত দু’টি মামলা ছাড়াও দু’টি মানহানির মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকায় সেগুলোতেও তাকে জামিন নিতে হবে। উচ্চ আদালতে এখন অবকাশ চলছে। ঈদের পর এসব মামলায় জামিন চাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে।
বিএনপির অনেক নেতা ও আইনজীবী মনে করেন, খালেদা জিয়া জামিন পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণেই তাকে কারাগারে আটকে রেখেছে। একই সাথে নি¤œ ও উচ্চ আদালতের ওপর সরকার সরাসরি প্রভাব ফেলছে। এ অবস্থায় আন্দোলন ছাড়া খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা সম্ভব নয়, যদি সরকারের সদিচ্ছা না থাকে।
খালেদা জিয়া কারান্তরীণ হওয়ার পর জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল, অবরোধের মতো কঠোর কোনো আন্দোলনের পথে যায়নি দলটি। মানববন্ধন, অনশন, প্রতিবাদী সমাবেশ বা জনসভার মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল খালেদার মুক্তির দাবি, যা খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার জন্য যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন বিএনপির সিনিয়র অনেক নেতাই।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, একদিন পরই পবিত্র ঈদুল ফিতর। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই ঈদ সবচেয়ে স্বস্তিদায়ক নয়, সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঈদ হবে এবার। কারণ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে জোর করে কারাবন্দী রাখা হয়েছে। তাই বেশির ভাগ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঈদের আনন্দ নেই।
জানা গেছে, বিএনপির সিনিয়র নেতা ও বিগত নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পাওয়া নেতাদের নেতাকর্মীদের পাশে থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ইতোমধ্যে তিনি মামলা, হামলা ও গুম হওয়া ৮’শর বেশি পরিবারে ঈদের উপহার পাঠিয়েছেন। খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকেও এসব পরিবারে ঈদ উপহার পাঠানো হয়েছে।
বিএনপি ঈদের পর কী করবে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এখনো হয়নি বলে জানা গেছে। মধ্যবর্তী নির্বাচনও খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলনে নামার কথা বলছেন অনেকে। বিএনপির শুভাকাক্সক্ষী হিসেবে পরিচিত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য বিএনপিকে রাস্তায় নামতে হবে। বিএনপির প্রতিটি অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের পাশাপাশি ঢাকা মহানগরের প্রতিটি ওয়ার্ড থেকেও মিছিল বের হতে হবে। দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দকেও রাস্তায় নামতে হবে। তাহলে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি জোরালো হবে। তখন সরকারও বিষয়টি বিবেচনায় নিতে বাধ্য হবে।
জানা গেছে, ঈদের পর বিএনপি নির্বাহী কমিটির সভা ডাকতে পারে। ৫ এমপির শপথগ্রহণসহ নানা ইস্যুতে নির্বাচনের পর দলের বিভিন্ন পর্যায়ে যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে, তা নিরসনে এ বৈঠক ডাকার কথা ভাবা হচ্ছে। দলটির সিনিয়র নেতারা ইতোমধ্যে এ ধরনের বৈঠক ডাকার তাগাদা দিয়েছেন। তারা বলেছেন, সব নেতাকে ঢাকায় ডেকে এনে মনের কথা বলতে দেয়া প্রয়োজন। এতে করে সাময়িক যে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে, তা কেটে যাবে। দল আরো ঐক্যবদ্ধ হবে।