বিজ্ঞানময় রোজা : কিছু কথা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন

276


মুসলমানের চারটি মৌলিক বিশ্বাস বা ইসলামের চারটি মূল স্তম্ভ হলো : নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাত। তার মধ্যে পবিত্র কোরআন শরিফের বিভিন্ন আয়াতে নামাজ সম্পর্কে সর্বোচ্চ তাগিদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নামাজ কত রাকাত হবে এবং কীভাবে কায়েম করতে হবে, তা পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় যে, আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআন শরিফের বিভিন্ন আয়াতে মুসলমানদের জন্য রোজাকে ফরজ করা, রোজা রাখার সময়কাল, রোজার আনুষঙ্গিক করণীয় যথা- সাহরি, ইফতার, তারাবি এবং রোজার মাসে পবিত্র কোরআন নাজিল, কোরআন নাজিলের রাতের (লাইলাতুল কদর) অপরিসীম গুরুত্ব, রোজা পালনের মাধ্যমে বান্দার গুনাহ মাফসহ সীমাহীন নেয়ামত সম্পর্কে বিস্তারিত নির্দেশনা দিয়েছেন।

অপর দুটি স্তম্ভ : হজ পালন ও জাকাত আদায়ের বিষয়েও পবিত্র কোরআন শরিফের যেসব আয়াত নাজিল হয়েছে, তার মধ্যে সূরা আল বাকারার ১৮৪ নম্বর আয়াতের শেষ অংশে বলা হয়েছে, ‘(অবশ্য) তোমরা যদি রোজা রাখতে পার (তা হলে) সেটা তোমাদের জন্য ভালো; যদি তোমরা (রোজার উপকারিতা) সম্পর্কে জানতে পারতে। ’
সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানের জন্য রোজা ফরজ করা হয়েছে (সূরা আল বাকারা-১৮৩)। রমজান মাস রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের মাস।

এ মাসে আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে তার সৃষ্টিকুলের জন্য আসমান থেকে রহমত ও বরকত অবিরাম ধারায় নামতে থাকে। এ মাসে রোজা বা সিয়াম পালনের মাধ্যমে মুসলমানরা তাকওয়া অর্জন এবং আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংযম লাভ করে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে রোজার মাধ্যমে প্রত্যেক মুসলমান আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক ইহকাল ও পরকালের মঙ্গলের জন্য রোজা পালন করে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণের সম্পূরক হিসেবে পবিত্র কোরআন শরিফের উল্লিখিত আয়াতে ‘রোজার উপকারিতা’ সম্পর্কে যে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে বিজ্ঞান গবেষণা করেছে। রোজা রাখার ফলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক উপকারিতা কী পরিমাণ আছে তা নির্ণয় করতে সমর্থ হয়েছে।

মুসলমানরা যে কার্যক্রমকে ‘রোজা’ বলেন, অন্যরা তাকে উপবাস (Fasting) বলে থাকেন। রোজা শুধু মুসলমানের জন্যই ফরজ করা হয়নি। পবিত্র কোরআন শরিফের সূরা আল বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে মানব তোমরা যারা ইমান এনেছ, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করে দেওয়া হয়েছে, যেমন করে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, আশা করা যায় তোমরা (এর মাধ্যমে) তাকওয়া অর্জন করতে পারবে। ’ হজরত আদম (আ.) থেকে হজরত ঈসা (আ.)-এর ওপর এবং তাঁদের উম্মতদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছিল। তবে রোজার সময়সীমা, সংখ্যা ও রোজা রাখার নিয়মের হেরফের ছিল।

বর্তমান যুগে মুসলমান ছাড়াও ইহুদি, খ্রিস্টান, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বিভিন্ন নামে উপবাস (Fasting) বা রোজা পালন করে। তাই এটা প্রমাণিত যে, মানুষের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালা সব যুগে সব ধর্মের মানুষের ইহকাল ও পরকালের মঙ্গলের জন্য রোজা রাখার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন। বিজ্ঞানীরা এই সত্যকে উপলব্ধি করে রোজা বা উপবাস (Fasting) সম্পর্কে গবেষণা শুরু করে।
একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য উপবাস (Fasting) বা রোজা পালন করলে কোনো ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার ফলে সক্রিয় সেলগুলো মানুষের শরীরে দূষিত, মৃত ও অপ্রয়োজনীয় সেলগুলোকে ধ্বংস করে বা খেয়ে শরীরকে সুস্থ রাখে। এ বিষয়ে জাপানি বিজ্ঞানী ওশিওমি ওহসুমি (Yushiomi Ohsumi) অটোফেজি (Autophasy) -এর প্রক্রিয়া আবিষ্কার করে বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার এই আবিষ্কার চিকিৎসা ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী ও মানুষের অনেক রোগব্যাধির প্রতিষেধক হিসেবে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এই মৌলিক আবিষ্কারের জন্য ২০১৬ সালে ওশিওমি ওহসুমি চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। অটোফেজি একটি গ্রিক শব্দ। ‘অটো’ ও ‘ফাজেইন’ এ দুটি শব্দের সংমিশ্রণে ‘অটোফেজি’ শব্দটি সৃষ্টি হয়েছে। গ্রিক এই শব্দের অর্থ ‘আত্মরক্ষণ’ বা ‘নিজেকে খেয়ে ফেলা’।

আমাদের শরীরের কোষগুলো সারা দিন খাদ্য না পেয়ে ক্ষুধার্ত অবস্থায় শরীরের মৃত, অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকারক কোষগুলোকে খেয়ে ফেলে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে এ প্রক্রিয়ায় নতুন কোষের সৃষ্টি হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, মানুষের দেহে গড়ে ৩৭.২ ট্রিলিয়ন কোষ রয়েছে। দেহের ওজন ও উচ্চতার ওপর নির্ভর করে এই কোষের সংখ্যা কম-বেশি হতে পারে। মানুষের দেহে বিভিন্ন ধরনের কোষ রয়েছে, যার মধ্যে ১০ ধরনের কোষ (যথা রক্ত কোষ (Blood Cell) , মাংস-পেশি কোষ (Muscle Cell), চর্বি কোষ (Fat Cell), চর্ম কোষ (Skin Cell) , শিরা-উপশিরা কোষ (Nerve Cell) ইত্যাদি)। দেহের অভ্যন্তরে ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে জীবনী শক্তি পরিচালনা করে। কোষগুলো সংঘবদ্ধভাবে একটি গ্রুপে মিলে সৃষ্টি হয় টিস্যু, আর টিস্যুগুলোর সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যথাÑহার্ট, ব্রেইন, কিডনি ইত্যাদি। সাধারণত দেহের কোষগুলোর বিন্যাসের ওপর নির্ভর করে দেহের গঠন ও গড়ন (Body Structure) । দেহের কোষ খাদ্য থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে এবং পুষ্টি থেকে শরীরের শক্তি (Energy) সঞ্চার করে। কোষ মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সক্রিয় ও সচল রাখে।

প্রাকৃতিক নিয়মে আল্লাহর সৃষ্টি সব জীব যেভাবে মৃত্যুবরণ করে, তেমনিভাবে আমাদের দেহের কোষগুলো একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর মৃত্যুবরণ করে। বিজ্ঞানীদের মতে, সুঠাম দেহের অধিকারী একজন ব্যক্তির ৫০ থেকে ৭০ বিলিয়ন কোষের প্রতিদিন মৃত্যু হয়। এসব মৃত্যু কোষের আধিক্য ও একত্রিত হলে শরীরে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া মানুষ অনিয়ন্ত্রিত পানাহারের মাধ্যমে যেসব খাবার শরীরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে, তা দেহের কোষগুলো সংমিশ্রণ প্রক্রিয়ায় হরমোন পরিবর্তনসহ ক্ষতিকারক ভাইরাস, টক্সিক (Toxic) পদার্থ ও বিভিন্ন রোগ সৃষ্টির অণুগঠক হিসেবে কাজ করে।

নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রোজা রাখলে বা উপবাস (Fasting) করলে অটোফেজির এ প্রক্রিয়ায় দেহের অভ্যন্তরে জমাকৃত মৃত, পুরনো ও অপ্রয়োজনীয় কোষ এবং প্রোটিনকে সরিয়ে দিয়ে নতুন কোষ প্রতিস্থাপিত হয়। এ প্রক্রিয়ায় দেহের অভ্যন্তরে জমে থাকা ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস ধ্বংস করে দিতে সাহায্য করে। রোজা বা উপবাসের মাধ্যমে মানব দেহের নতুন ও প্রয়োজনীয়

হরমোন তৈরিতে সাহায্য করে এবং মানুষের দেহকে পূর্ণাঙ্গ পুনর্গঠন (Renovation) করে। বিজ্ঞানীদের মতে, একমাস যাবৎ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রোজা বা উপবাস করলে অটোফেজি নিয়ন্ত্রিতভাবে দেহে প্রভাব বিস্তার করে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, নির্দিষ্ট সময়ে নিয়ন্ত্রিত পানাহার এবং ১২/১৮ ঘণ্টা একটানা অভুক্ত থাকলে অর্থাৎ মুসলমানদের ‘রোজা’ রাখার ফলে শরীরের বিভিন্ন সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। রোজা হার্টের রোগীর জন্য উপকারী। দীর্ঘ সময় না খাওয়ার ফলে শরীরে উচ্চ কোলেস্টেরেল (High Cholesterol) মাত্রা হ্রাস করতে সাহায্য করে। হজম প্রক্রিয়া দীর্ঘ সময় বিশ্রাম পাওয়ার সুযোগে দেহের টক্সিন পদার্থ ধ্বংস করতে সমর্থ হয়। রোজার প্রভাবে মস্তিষ্কের সক্রিয় কোষ মৃত কোষকে খেয়ে বা ধ্বংস করে মস্তিষ্ককে সুরক্ষা করে এবং এর ফলে দুশ্চিন্তা ও হতাশা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায়। একটি নির্দিষ্ট দীর্ঘ সময় পানাহার না করায় মাংস-পেশি কোষের (Muscle Cell) জমাকৃত ও অপ্রয়োজনীয় অংশ চর্বি (Fat) স্বয়ংক্রিয়ভাবে হ্রাস পায়। এ প্রক্রিয়ায় দেহের ওজন (Obesity) কমাতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। রোজার সময় দেহের সৃষ্ট গ্লুকোজ ব্যবহার করে ফেলে বা খেয়ে ফেলে। যার ফলে দেহে জমা হওয়া চর্বি (Fat) পুড়ে (Burn) গিয়ে শক্তিতে রূপান্তরিত হয় এবং দেহের ওজন হ্রাস পায়। রোজা রাখার প্রভাবে অটোফেজি সক্রিয় হয় এবং দেহে সৃষ্ট ক্যান্সার কোষগুলোকে ধ্বংস করে দেহকে ক্যান্সার মুক্ত করতে ভূমিকা রাখে। ক্যান্সার সেল যাতে নতুন করে সৃষ্টি হতে না পারে সে জন্য এটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরিতে সাহায্য করে। এ ছাড়া রোজা রাখার ফলে উচ্চ রক্তচাপ ও ব্লাড সুগার হ্রাস পাওয়ায় ডায়াবেটিস ও হাইপারটেনশন রোগীদের নিরাময়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।

আল্লাহতায়ালা মানুষের দেহ সূচারুরূপে ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালনার জন্য যে মেশিন সৃষ্টি করে দিয়েছেন, তা মানুষের সৃষ্ট যে কোনো যন্ত্র বা মেশিন থেকে উৎকৃষ্ট ও বিজ্ঞানসম্মত। মানবসৃষ্ট মেশিন (Engine) চালু রাখার জন্য যেভাবে সার্ভিসিং বা ওভারহোলিং করা প্রয়োজন হয়, তেমনি মানব দেহের যন্ত্রেরও সার্ভিসিং এবং ওভারহোলিং প্রয়োজন হয়। কোরআনের আলোকে এবং বিজ্ঞানের বিশ্লেষণে রোজা রাখার মাধ্যমে অটোফেজি প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করে মানবদেহের সার্ভিসিং, পুরনো পার্টস ফেলে নতুন পার্টস সংযোজন বা ওভারহোলিংয়ের কাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়ে থাকে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে রোজা প্রত্যেক মুসলমানের মনকে পার্থিব সব দিক থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে, আত্মসংযমী হতে শিক্ষা দেয়, ইহলোকে মানুষ যেসব পাপ বা খারাপ কাজ করেছে, তা থেকে ক্ষমা প্রাপ্তির মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি লাভ করে। সর্বোপরি আল্লাহর হুকুম তামিল করার ‘তাকওয়া’ অর্জন করে। বিজ্ঞানের গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, রোজা অটোফেজি (Autophasy) প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করে দেহের অভ্যন্তরে মৃত কোষ, অপ্রয়োজনীয় পদার্থ এবং জমাকৃত ক্ষতিকর বর্জ্যকে (Junk) সক্রিয় দেহ কোষগুলো খেয়ে ফেলে বা ধ্বংস করে দিয়ে মানুষের দেহকে সুস্থ, কার্যকর, সতেজ ও সক্রিয় রাখতে সাহায্য করে। পবিত্র কোরআন শরিফের সূরা আল-বাকারার ১৮৪ নম্বর আয়াতের শেষ অংশ বিজ্ঞানের আলোকে বিশ্লেষণ করে ইহলোক ও পরকালে রোজার সীমাহীন প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি করতে হবে। শুধু মুসলমানরা নয়, বিশ্বের সমগ্র মানব জাতিকে বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মকে পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শন পবিত্র ‘আল-কোরআন’ ও বিজ্ঞানকে গভীরভাবে আত্মস্থ করে ইহকালে ও পরকালে সফলতা অর্জন করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সেই তৌফিক দান করুন।

লেখক : সদস্য, জাতীয় স্থায়ী কমিটি-বিএনপি এবং সাবেক অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here