ত্রিভুবনের সবচেয়ে মধুরতম শব্দ ‘মা’। সবচেয়ে প্রিয়, পবিত্র, সর্বজনীন শব্দ মা। মা শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে অন্যরকম এক আবেগ-অনুভূতির জন্ম হয় হৃদয়ের অতল গহিনে। অনাবিল সুখ প্রশান্তির রেশ ছড়িয়ে দেয়। মা শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের হৃদয়ের মানসপটে ভেসে উঠে অসীম, চিরন্তন, আত্মত্যাগ, ভালবাসার প্রতিচ্ছবি, এক মমতাময়ী প্রতিমূর্তি। আজ বিশ্ব মা দিবস। এদিন মাতৃ অন্তঃপ্রাণ সন্তানেরা ‘জননী আমার তুমি, পৃথিবী আমার, মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে’-এই কথাটুকু প্রমাণে সারা বিশ্বেই নানা আয়োজনে সন্তানরা উদযাপন করেন মা দিবস। মা শব্দটি ছোট হলেও এর পরিধি বিশাল।
যে ভাষায় তাঁকে সম্বোধন করা হোক না কেন, সর্বকালে সর্বক্ষেত্রে সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকে দেশ ও কালের সীমানা অতিক্রম করেও মায়ের আত্মত্যাগের ভালবাসার রূপ অনেকটা অভিন্ন। মায়ের অনুগ্রহ ছাড়া কোন প্রাণীরই প্রাণধারণ করা অসম্ভব। মায়ের দেহে নিউট্রোপেট্রিক রাসায়নিক পদার্থ থাকায় মায়ের মনের মাঝে সন্তানের জন্য জন্ম নেয় মমতা।
মায়ের ভালোবাসার ক্ষমতা বিজ্ঞানের মাপকাঠিতেও নির্ণয় করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর সব দেশেই এই মা শব্দটিই কেবল সর্বজনীন। মাকে ঘিরেই পরিবারের স্বাভাবিক বিকাশ সাধিত হয়। পরিবারে মা হচ্ছেন এক স্বর্গীয় বিস্ময়কর প্রতিষ্ঠান। মহিয়সী মায়ের তত্ত্বাবধানেই শিশুকাল থেকে ছেলে-মেয়েরা সুসন্তান হিসেবে গড়ে ওঠে। মা প্রথম কথা বলা শেখান বলেই মায়ের ভাষা হয় মাতৃভাষা। মা হচ্ছেন মমতা-নিরাপত্তা-অস্তিত্ব, নিশ্চয়তা ও আশ্রয়। মা সন্তানের অভিভাবক, পরিচালক, দার্শনিক, শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ও বড় বন্ধু। নিষ্ঠা সহকারে দায়িত্ব পালনে মায়েরা থাকেন সন্তানদের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। সন্তানদের সুশৃঙ্খল, শিষ্ট ও সর্বক্ষেত্রে যোগ্য হয়ে গড়ে উঠার পেছনে থাকে একমাত্র মায়েদের অক্লান্ত অবদান। সুমাতার সাহচর্যে গড়ে ওঠা সন্তানই সমাজ ও রাষ্ট্রের সুনাগরিক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।
মা দিবস, প্রচলন নিয়ে রয়েছে নানা গল্প, ইতিহাস। জুলিয়া ওয়ার্ড হোই রচিত ‘মাদার্স ডে প্রক্লামেশন’ প্রচেষ্টাগুলোর মধ্যে অন্যতম। আমেরিকান গৃহযুদ্ধ ও ফ্রাঙ্কো-প্রুশীয় যুদ্ধের নৃশংসতার বিরুদ্ধে ১৮৭০ সালে রচিত হোই-এর মা দিবসের েেঘাষণাপত্রটি ছিল একটি শান্তিকামী প্রতিক্রিয়া। রাজনৈতিক স্তরে সমাজকে গঠন করার ক্ষেত্রে নারীর একটি দায়িত্ব আছে, হোই-এর এই নারীবাদী বিশ্বাস ঘোষণাপত্রটির মধ্যে নিহিত ছিল। ১৯১২ সালে আনা জার্ভিস স্থাপন করেন মাদারস ডে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোশিয়েশন (আন্তর্জাতিক মা দিবস সমিতি) এবং মে মাসের দ্বিতীয় রোববার মা দিবস-এর বহুল প্রচার করেন। পরে মা দিবসটি সর্বজনীন করে তোলার লক্ষ্যে এগিয়ে আসেন জুলিয়া ওয়ার্ড নামের এক আমেরিকান। ১৯১৪ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন দিবসটিকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেন। এরপর মা দিবস পালনের রেওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর সব দেশে। কিন্তু মাতৃত্বের উদযাপন নতুন কোন ধারণা নয়। সন্তানের জন্য মায়ের যে সীমাহীন অবদান ও ত্যাগ স্বীকার, তার প্রতি একধরণের কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন যুগে যুগে নানা সভ্যতাতেই ছিল। যেমন- গ্রিক উৎসব ‘সিবেল’, রোমান ‘হিলারিয়া’ ও খ্রিস্টান রীতি অনুযায়ী ‘মাদারিং সানডে’র মাধ্যমে মায়ের জন্য বিশেষ একটি দিনের উদযাপন প্রচলিত ছিল হাজার বছর ধরে। ‘মা দিবসের’ প্রথম প্রচলন হয় প্রাচীন গ্রিসে। সেখানে প্রতিটি বসন্তকালে একটি দিন দেবতাদের মা ‘রিয়া’ উদ্দেশ্য উদ্যাপন করা হতো। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় নানা দৃষ্টিকোণ থেকে পালিত হতো ‘মা দিবস’। এশিয়া মাইনরে মহাবিষ্ণুবের সময় ও রোমে আইডিস অফ মার্চে এই উৎসবটি পালিত হত ১৫ই মার্চ থেকে ১৮ই মার্চের যে কোন দিন। দিনটি তারা ‘জুনো’র প্রতি উৎসর্গ করেছিলেন। ষোড়শ শতাব্দী থেকে দিনটি যুক্তরাজ্যে উদযাপন শুরু হয় ‘মাদারিং সানডে’ হিসেবে। ইস্টার সানডের ঠিক তিন সপ্তাহ আগের রোববার তারা এই দিনটি পালন করতেন।
ইসলামে মায়ের মর্যাদা অসীম। মাকে সমাসীন করেছেন অভাবনীয় মর্যাদার আসনে। মহান আল্লাহ তা’য়ালা স্বীয় রাসুলে পাক (সা.)-এর পরে মাকে সর্বোচ্চ আসন দিয়েছেন। বলা হয়েছে, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। বুখারী শরীফের হাদিসে আছে নবী করিম (সা.)-এর কাছে এক সাহাবি জিজ্ঞাসা করলেন- আমার উপর সবচেয়ে বেশি অধিকার কার? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন- তোমার মায়ের। এভাবে তিনবার প্রশ্ন করলে তিনবারই তিনি উচ্চারণ করেন মা। চতুর্থবার রাসুলুল্লাহ (সা.) উচ্চারণ করেন বাবা। উপনিষদে বর্ণনা করা হয়েছে- ‘মাতৃ দেব ভব’? অর্থাৎ মা দেবী স্বরূপিনী, জীবন্ত ঈশ্বরী? হিন্দুধর্মে মহাশক্তি, আদিশক্তি, রক্ষাকর্ত্রীর ভূমিকায় যারা চিত্রিত হয়েছেন প্রত্যেকেই মাতৃরূপে। মাকে স্মরণ করে জগদ্বিখ্যাত মনীষী আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন- ‘আমি যা কিছু পেয়েছি, যা কিছু হয়েছি, অথবা যা হতে আশাকরি, তার জন্য আমি আমার মায়ের কাছে ঋণী’। নেপোলিয়নের সেই সর্বজনীন কথাটি খুব প্রসিদ্ধ- ‘আমাকে একজন ভাল মা দাও, আমি তোমাদের একটি ভাল জাতি উপহার দেব।’ মাকে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানানোর নির্দিষ্ট কোন দিনক্ষণ নেই। মায়ের প্রতি ভালবাসা প্রতি মুহূর্তের। তারপরও বিশ্বের সকল মানুষ যাতে একসঙ্গে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারে সে জন্য পালন করা হয় আন্তর্জাতিক মা দিবস। তবে এখনো বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন তারিখে পালিত হয় মা দিবস।
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন- ‘আমি ভীষণ ভালবাসতাম আমার মা-কে/কখনও মুখ ফুটে বলিনি/টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে/কখনও কখনও কিনে আনতাম কমলালেবু/শুয়ে শুয়ে মা-র চোখ জলে ভরে উঠত’। অধিকাংশ বাঙালি ছেলে-মেয়ের গল্পটাই বোধ হয় এমন। আমরা মাকে যতই ভালোবাসি না কেন, কিছুতেই কেন জানি মুখ ফুটে তাকে সে কথা বলতে পারিনা। বলতে পারিনা, মায়ের মুখটা আমাদের কত প্রিয়। আসুন মায়ের জন্য উৎসর্গ করি অন্তত একটি দিন। মায়ের সাথে কাটাই অমূল্য কিছু সময়।
আন্তর্জাতিক মা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল মাকে আন্তর্জাতিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। মা দিবসের বাণীতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘গণতন্ত্রের মা’ বেগম খালেদা জিয়াকে অন্যায়ভাবে সাজা দিয়ে এক ভয়াল কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছে। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বিকাশ ও অগ্রসর সমাজ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে তাঁর রাজনৈতিক জীবন কেটেছে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম ও নিরলস পরিশ্রমে। তাঁর নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল।
আজকের এই দিনে নারী শিক্ষার আলোকবর্তিকা খালেদা জিয়া স্বেচ্ছাচারীর কারাগারে বন্দী-তাঁকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি-দায়িত্বশীল ও শিক্ষায় আলোকিত মায়েদের সুসন্তানরাই দীর্ঘদিনের অচলায়তন ভেঙে সামাজিক অগ্রগতি তরান্বিত করবে। আজকের দিনে আমার প্রত্যাশা সকল মা যেন তার সন্তানদের যোগ্য ও সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হন। বর্তমানে নারী-শিশুর ওপর নির্যাতনের হিড়িকে ভয়ানক নৈরাজ্যে সমাজে বিপজ্জনক পরিস্থিতি বিরাজমান। এমতাবস্থায় কেবলমাত্র সুমাতাই সন্তানকে নির্ভুল, সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। ‘গণতন্ত্রের মা’ খালেদা জিয়াকে আজ প্রতিহিংসার বিচারে পরিত্যক্ত একটি নির্জন কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছে। কেড়ে নেয়া হয়েছে মানুষ হিসেবে তাঁর সকল মানবাধিকার। এই মহিমান্বিত দিবসে আমি তাঁর সুস্বাস্থ্য কামনা ও নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছি।