আসন্ন শীতকালে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ আরো ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মানুষকে প্রশিক্ষিত করা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে চলতে উৎসাহ দেয়া, পর্যাপ্ত পরীক্ষা নিশ্চিত করা ও বিদেশ থেকে আগতদের কঠোরভাবে কোয়ারেন্টাইন মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে।
পাশাপাশি তারা বলছেন, কোভিডের প্রথম ঢেউ থেকে শিক্ষা নিয়ে ও পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সরকারকে একটি রোডম্যাপ তৈরি এবং কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যাতে শীতকালীন সম্ভাব্য ঢেউ নিয়ন্ত্রণে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে আক্রান্তদের সঠিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়।
সেই সাথে তারা সরকারকে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে দৈনিক ব্রিফিং পুনরায় চালু করার পরামর্শ দিচ্ছেন যাতে সরকারের প্রচেষ্টার সাথে জড়িতদের যথাযথ বার্তা সরবরাহ করা যায়। কেননা দেশে কোভিড শনাক্তের সংখ্যা কমার কারণে অনেকের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনীহা দেখা দিয়েছে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করে দিয়ে শীতকালে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হতে পারে বলে জানিয়েছেন এবং সে অনুযায়ী সবাইকে প্রস্তুতি জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন, প্রচলিত অন্যান্য ভাইরাস ও ফ্লুয়ের কারণে শীতকালে করোনা কিছুটা দুর্বলও হয়ে পড়তে পারে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা দলের অন্যতম বিভাগীয় সদস্য ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘শীতকালে মানুষ সাধারণত জ্বর, কাশি, হাঁচি এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা ও ভাইরাসজনিত বিভিন্ন সর্দিজনিত রোগে আক্রান্ত হয়। অন্যদিকে, করোনাভাইরাস শীত আবহাওয়ায় দীর্ঘকাল ধরে বেঁচে থাকতে পারে। তাই, এ সময় সংক্রমণের হারের ক্ষেত্রে একটা উত্থান দেখা দিতে পারে। শীতকালে ভাইরাসটির সম্ভাব্য ঢেউয়ের বিষয়ে আমরা সরকারকে সতর্ক করেছি এবং তা মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘দেশে করোনা সংক্রমণের হার কমলেও মৃত্যুর হার এখনো অনেক বেশি, যা ভাইরাসটির স্থানীয় সংক্রমণ উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এখনই যদি আমরা সঠিক রোডম্যাপ তৈরি করতে না পারি তবে এ জন্য আমাদের অনেক কঠিন মূল্য দিতে হবে।’
ডা. ফয়সাল বলেন, ‘মাস্ক পরা, জনসমাগম এড়িয়ে চলা, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহার এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ মানুষকে স্বাস্থ্য সুরক্ষার নির্দেশনা সঠিকভাবে মেনে চলতে উৎসাহিত করার জন্য সরকারকে আমরা একটি কৌশল অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছি।’
তিনি বলেন, এর পাশাপাশি শীতে এ ভাইরাসের নতুন করে প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণের উপায় হিসেবে সব জেলায় পর্যাপ্ত পরীক্ষার কিট এবং পিসিআর ল্যাবগুলো চালু রাখা, সংক্রমিতদের যত্ন নেয়া ও তাদের সংস্পর্শে আসাদের চিহ্নিত করে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো যেতে পারে।
ডা. ফয়সাল বলেন, ভাইরাসটির সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে নিজেদের রোডম্যাপ তৈরি করতে স্থানীয় মানুষের সাথে আলোচনার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। ‘করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা ও কর্মসূচিতে আমাদের অবশ্যই সাধারণ মানুষদের সম্পৃক্ত করতে হবে। তাদের সম্পৃক্ততা ও সহযোগিতা ছাড়া আমরা শীতে করোনার সম্ভাব্য ঢেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না।’
প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, ‘এটা ধারণা করা হয় যে ইউরোপের কয়েকটি দেশের মতো শীতের সময় আমাদের দেশেও করোনা কিছুটা তীব্র আকার ধারণ করতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘শীতকালে ধূলিকণার দূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করে এবং আর্দ্রতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায়। আর ভাইরাল ফ্লু’র উত্থানের কারণের শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ দেখা দেয়। যেহেতু এ সময় মানুষ বিভিন্ন ঠাণ্ডাজনিত ভাইরাস ও ফ্লুতে আক্রান্ত হয়, ফলে এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা করোনাভাইরাসযুক্ত ড্রপলেটগুলো দ্বারা তারা সহজেই সংক্রমিত হতে পারে। তাই, শীতকালে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে বলে আমরা মনে করছি।’
ডা. আবদুল্লাহ বলেন, ‘সম্প্রতি স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি ও নির্দেশনা মেনে চলার বিষয়ে অনীহা মানুষের মধ্যে দৃশ্যমান হয়ে ওঠায় প্রধানমন্ত্রী জনগণকে সচেতন করা বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করে দিয়েছেন। ভাইরাস সংক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য আমাদের অবশ্যই মানুষকে সচেতন করতে হবে, প্রশিক্ষিত করতে হবে এবং ক্ষমতায়িত করতে হবে। আত্মরক্ষাই করোনার মতো মহামারি প্রতিরোধের সবচেয়ে ভালো উপায়।’
মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব ও অন্যান্য নিয়ম মেনে চলার প্রতি জনসাধারণ উদাসীন হয়ে ওঠায় মানুষজনকে সেগুলো অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করতে জোরালো প্রচার চালানোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে মানুষের সচেতনতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’
এছাড়াও তিনি বলেন, ‘বিদেশ থেকে আসা লোকদের স্ক্রিনিংয়ের বিষয়ে সরকারকে কঠোর হতে হবে এবং তাদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে পাঠাতে হবে। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পুনরায় চালু হওয়ায় বিদেশ থেকে আসা আক্রান্তদের দ্বারা সংক্রমিত হওয়া রোধ করতে আমাদের অবশ্যই প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিতে হবে। ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে টেস্টিং ও ট্রেসিংও প্রয়োজন। আমি আশা করি, আমরা করোনাকে মোকাবিলা করতে পারব। ইতোমধ্যে আমাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে করোনা সংক্রমণ বাড়লেও আমার আরও কার্যকরভাবে একে মোকাবিলা করতে পারব।’
প্রধানমন্ত্রীর এ ব্যক্তিগত চিকিৎসক বলেন, ‘শীতকালে পরিস্থিতি আরো খারাপ হলে যেন তা মোকাবিলা করতে পারি সে জন্য হাসপাতালগুলোকে প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জাম ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে প্রস্তুত রাখতে হবে। আমাদের অতীতের তুলনায় চিকিৎসকদের জন্য পর্যাপ্ত মানসম্মত মাস্ক, পিপিই ও অন্যান্য সুরক্ষাসামগ্রীর ব্যবস্থা করা উচিত যাতে তারা কোনো ধরনের দ্বিধা ছাড়াই রোগীদের চাপ সামলাতে পারেন।’
যোগাযোগ করা হলে, প্রখ্যাত ভাইরাসবিদ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক ভিসি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, দেশে এখনো করোনাভাইরাস উদ্বেগজনক হারে বিরাজ করছে। এরই মধ্যে বিশেষজ্ঞরা শীতকালে এ সংক্রমণ হার আরও তীব্র হতে পারে বলে হুঁশিয়ার করছেন।
তিনি বলেন, ‘তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, অন্যান্য ভাইরাস ও ফ্লু জাতীয় রোগের কারণে পরিস্থিতির এতটা অবনতি নাও হতে পারে। অন্যান্য ভাইরাসের প্রকোপের কারণে শীতকালে করোনা আরো দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। এটি আমার অনুমান, তবে আমাদের সতর্ক থাকা উচিত ও সব ধরনের প্রতিরোধমূলক প্রস্তুতি নিয়ে রাখা উচিত, কেননা বিভিন্ন পরিস্থিতি ও ঋতুতে করোনার আলাদা আলাদা রূপ দেখা যাচ্ছে।’
জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির (এনটিএসি) সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারকে কিছু বৈজ্ঞানিক অনুমানের ওপর ভিত্তি করে পরিস্থিতি যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে করোনায় দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় পদক্ষেপ নেয়া উচিত।’