প্রয়াত জিয়াকে প্রণতি -মারুফ কামাল খান

406

মারুফ কামাল খান

জিয়াউর রহমান খুব বেশি দিন বাঁচেন নি। অল্প বয়সেই নিহত হয়েছেন। রাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্তব্যরত অবস্থায় তিনি শহীদ হন। তাঁর মৃত্যুর পর অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। একটা দল তিনি গড়ে গিয়েছেন। জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি নামের সে দল জিয়া শহীদ হবার পরপরই ক্ষমতাচ্যুত হয়। তখনকার সেনাপতি এইচ এম এরশাদ ক্যু করে ক্ষমতা কেড়ে নেন। লোভ-টোপ দিয়ে ও জুলুম করে সেই দল ভেঙে, দুর্বল করে তিনি নিঃশেষ করে দেয়ার চেষ্টা করেন। দলটি পড়ে যায় নেতৃত্বের সংকটে। এরশাদ মুছে দেয়ার চেষ্টা করেন জিয়ার নামও।
জিয়া ও তাঁর দলকে যারা অপছন্দ করতেন সেই রাজনীতিবিদেরা এবং প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোও ভেবেছিলেন জিয়া আর্মি থেকে আসা লোক। সেনানায়ক থেকে রাজনীতিবিদে রূপান্তরিত হয়েছেন ক্ষমতায় আসার পর। কাজেই তাঁর জনসমর্থনের ভিত্তি শক্ত-পোক্ত নয়; হালকা-পলকা। তারা বলতেন, জিয়ার দল তৈরি হয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতার ছত্রছায়ায়। প্রতিপত্তিকামী, ক্ষমতাপ্রেমী, সুবিধাশিকারী এবং রাজনীতির অঙ্গনে দীর্ঘ চেষ্টায়ও সুবিধা করতে না-পেরে হতাশ রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, দলছুট এবং পেশাজীবীদের মিলিয়ে মিশিয়ে তিনি দল বানিয়েছেন। এ দলে আদর্শ বা কর্মসূচি কথার কথা। জিয়া না থাকলে এবং ক্ষমতা হারালে এ দল আর টিকবে না। জিয়ার নামও মুছে যাবে মানুষের মন থেকে।
এই সব ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা খুব খুশি হয়েছিলেন এরশাদের ক্ষমতা দখলে। অথচ অচিরেই তাদের সবার সেই ধারণা ও মূল্যায়ন ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। তাদের মিলিত চেষ্টা সফল হয় নাই। জিয়ার নাম মুছে যায় নাই মানুষের মন থেকে। তাঁর দল বিএনপি ক্ষমতাহারা হয়েও নিঃশেষ হয়ে যায়নি।
রাষ্ট্রক্ষমতার মদতে ভাংচুর হওয়া এই দলটিই নয় বছর ধরে এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সবচে’ বেশি সোচ্চার ও সক্রিয় থাকে। এরশাদের ব্যাপারে আপসহীন অবস্থান নেয়। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ এবং নতুন প্রজন্মের ছাত্র-তরুণদের সেই ক্যাম্পেইনে জাতীয়তাবাদের পতাকার নিচে শামিল ও সমবেত করে। এভাবে শক্তি বাড়িয়ে অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সমাজশক্তিকে টেনে আনে স্বৈরাচার-বিরোধী সংগ্রামের কাতারে। নয় বছরের অবিরাম সেই আন্দোলন অবশেষে সফল হয় গণ-অভ্যুত্থানে উন্নীত হবার মাধ্যমে। এর সুফল হিসেবে ভাঙাচোরা একটি দল হয়েও বিএনপি নির্বাচনে জনরায় নিয়ে ক্ষমতায় ফেরে ১৯৯১ সালে।
জিয়া যখন বেঁচে ছিলেন তখনও তাঁর বিরুদ্ধাচারণ ও বৈরিতা কম ছিল না। কারণ তিনি ক্লীব, অকেজো, নিষ্ক্রিয় কিংবা নিস্তেজ চরিত্রের মানুষ ছিলেন না। ছিলেন সত্যিকারের যোদ্ধা, সাহসী, সক্রিয়, যোগ্য, দক্ষ, কর্মঠ, সৎ, দেশপ্রেমিক এবং নেতৃত্বের সহজাত গুণাবলীতে ভূষিত মানুষ। তাঁর ভেতরে ছিল আগুন। সেই আগুনের আঁচ তাঁর সান্নিধ্যে গেলেই পাওয়া যেতো। কাজেই তাঁর ব্যাপারে ঈর্ষাকাতর লোকের এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের অতি সতর্ক দৃষ্টি ও বৈরিতা থাকারই কথা। সেটা ছিলও বরাবরই।
জিয়াকে তুচ্ছ ভাবা বা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি কখনো। ১৯৬৫, ১৯৭১, ১৯৭৫ সাল সহ ইতিহাসের ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ পর্বগুলোতে তা প্রমাণিত হয়েছে। ইতিহাসের সেই ঘটনাবলীর বিশদ বিবরণ এখানে তুলে ধরার অবকাশ নেই।
সেনা-অফিসারদের কুচক্রী একটি ক্ষুদ্র অংশ, যারা চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে আচমকা অভিযান চালিয়ে তাঁকে হত্যা করেছিল তারাও কল্পনা করেনি সর্বস্তরের সেনাসদস্য এবং দেশপ্রেমিক আপামর জনসাধারণের হৃদয়ের মণিকোঠায় জিয়ার অবস্থান কতোটা দ্যুতিময়। প্রতিদ্বন্দ্বী ও বৈরিশক্তি ভুলেও ভাবেনি জীবিত জিয়ার চাইতেও এভাবে আরো অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠবেন মৃত জিয়া।
ইতিহাসের পাতা থেকে সমকালে চোখ ফেরালে আমরা দেখি প্রায় চৌদ্দ বছর ধরে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে নির্বাসিত বিএনপি। এই সময়কালে জিয়ার নাম ও স্মৃতি এবং তার দল কী-ধরণের বৈরিতা ও প্রতিকূলতার মধ্যে আছে তা’ পক্ষপাতদুষ্টতায় পুরোপুরি অন্ধরা ছাড়া প্রতিটি মানুষই অনুভব করেন এবং জানেন ও বুঝেন।
তাতেই কি জিয়ার নাম মুছে গিয়েছে আমাদের জাতীয় ইতিহাস ও গণমানুষের হৃদয় থেকে? বিএনপি কি একেবারে শেষ হয়ে গেছে? কেউ কেউ হয়তো তা মনে করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে পারেন কিন্তু রাজনীতির রাসায়নিক বিশ্লেষণের ফলাফল ও জনমানসের নীরব ভাষা যারা পাঠ করতে পারেন তারা সকলেই জানেন এই আত্মতৃপ্তি কতোটা মিথ্যা ও মেকি!
আজও বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রবহমান প্রধান দুই ধারার একটির প্রতিনিধিত্ব করে বিএনপি এবং এই দলের আদর্শ, কর্মসূচি, ঐতিহ্য ও প্রেরণার উৎস হয়ে আছেন জিয়াউর রহমান।
ইতিহাসের সংকট ও প্রয়োজনের প্রতিটি মুহূর্তে ব্যক্তি জিয়া হয়ে উঠেছেন সমষ্টির জিয়া। দলের জিয়া হয়ে উঠেছেন দেশ ও জাতির জিয়া। তেমনই তার দর্শন, আদর্শ ও কর্মসূচি দলীয় গণ্ডি ছাড়িয়ে জাতীয় আদর্শ ও কর্মসূচিতে রূপান্তরিত হয়েছে বারবার। আমাদের এই জনপদে মানুষের অন্তরে জিয়া আজও জাগরূক থাকার কারণে তিনি ও তার আদর্শ এখনো হয়ে আছে জীবন্ত, সক্রিয়, কার্যকর ও প্রাসঙ্গিক। সে কারণেই জিয়া বারবার ফিরে আসেন, বারবার ফিরে আসবেন। জিয়ার ওপর অবিচল থাকলে বিএনপিও পুনরুত্থিত হবে। নতুবা, জাতীয় প্রয়োজনে সময়মতো জিয়া তার আদর্শসহ ফের ফিরবেন অন্য আদলে, ভিন্ন রূপে।
শাহাদাৎ বার্ষিকীতে সামান্য এই ক’টি পংক্তির মাধ্যমে অসামান্য এক মানুষের প্রতি অভিবাদন।

মারুফ কামাল খান: লেখক,সিনিয়র সাংবাদিক

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here