বিরোধী নেতাকর্মীদের ধরপাকড় অব্যাহত- বারো শ’ মামলায় আসামি দেড় লাখ

398

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিএনপিসহ বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ধরপাকড় অব্যাহত রয়েছে। এখন কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি না থাকলেও থেমে নেই পুলিশের গ্রেফতারবাণিজ্য। বিএনপির তৃণমূল থেকে মধ্যম সারির নেতাকর্মীদের অনেকেই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। বাসাবাড়িতে ঠিকমতো থাকতে পারছেন না। বিএনপি বলছে, কোরবানির ঈদের কয়েক দিন আগে থেকে গতকাল পর্যন্ত দেড় সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই গ্রেফতার চলমান। নতুন করে মামলা হয়েছে ১২ শতাধিক। নাম উল্লেখ করে আসামির সংখ্যা ১১ হাজার এবং অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার। গ্রেফতার অভিযানের পাশাপাশি পুরনো মামলাগুলো সচল করা হচ্ছে। অনেক সিনিয়র নেতার বিরুদ্ধেও নতুন করে মামলা দেয়া হচ্ছে। সরকার দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপিকে নির্বাচনপ্রক্রিয়ার বাইরে রাখার জন্যই বেআইনিভাবে গ্রেফতার করা হচ্ছে বলে দলটির নেতাদের অভিযোগ। তবে আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনী বলছে, যাদের আটক করা হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মামলা রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত পয়লা সেপ্টেম্বর দলের ৪০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জনসভার আয়োজন করে বিএনপি। কিন্তু জনসভাকে ঘিরে আগের দিন রাতেই ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সভাপতি ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল এবং বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলনের সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় পুলিশ তল্লাশি চালায়। জনসভায় ব্যাপক উপস্থিতির পর হঠাৎ করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপির নেতাকর্মীদের ধরপাকড় বেড়ে গেছে। নেতাকর্মীদের বাসাবাড়িতে তল্লাশি চালায় পুলিশ। ছাত্রদলের সহসভাপতি আলমগীর হাসান সোহান, আবু আতিক আল হাসান মিন্টু, যুগ্ম সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ, মফিজুর রহমান আশিক, বায়েজীদ আরেফিনসহ অনেকেই জানান, তারা ঠিকমতো বাসায় থাকতে পারেন না। সব সময় গ্রেফতার আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়।

এদিকে গত ৬ আগষ্ট ঢাকায় ছাত্র আন্দোলকে ইস্যু করে মিরসরাই ও জোরারগঞ্জ থানায় দুটি গায়েবি মামলা দায়ের করা হয়েছে। দুই মামলায় ১২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত সহ প্রায় আড়াইশ জনকে আসামী করা হয়। ওই মামলায় হাইকোট থেকে জামিন নিলেও নিন্ম আদালতে জামিন চাইতে গেলে জামিন না দিয়ে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। কারাগারে যাওয়া নেতারা হলেন উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক গাজী নিজাম উদ্দিন, বারইয়াররহাট পৌরসভা বিএনপির আহবায়ক দিদারুল আলম মিয়াজী, জোরারগঞ্জ ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাসুকুল আলম সোহান, হিঙ্গুলী ইউনিয়ন বিএনপি নেতা বেলাল হোসেন, উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহবায়ক ইফতেখার মাহমুদ জিপসন, ছাত্রদল নেতা আনোয়ার হোসেন। এছাড়া মিরসরাই থানায় মামলার আসামীরা হলেন উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব সালাহ উদ্দিন সেলিম, বিএনপি নেতা জহির উদ্দিন হুমায়ুন ও যুবদল নেতা এসএম হারুন।

মিরসরাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বলেন, ক্ষমতাসীন ফ্যাসিবাদী ও গণবিরোধী সরকারের ভেতরে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। ক্ষমতা হারানোর ভয় পেয়ে বসেছে। এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, সরকার আবারো ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো আরেকটি ভোটশূন্য নির্বাচন করতে চায়। কিন্তু বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল তা চায় না। সে জন্যই প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে সরকার বিএনপিকে টার্গেট করেছে। যাতে বিএনপি আন্দোলন করতে না পারে। ফলে কোনো উসকানি ছাড়াই হামলা-মামলা করছে সরকার। তবে সরকার যতই নির্যাতন করুক, কৌশল গ্রহণ করুক কোনো লাভ হবে না। দেশবাসী এবার একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ। তিনি আরো বলেন, সরকার শেষ বেলায় এসে আরো বেশি উম্মাদ হয়ে গেছে। কোন কারণ ছাড়াই বিএনপি নেতৃবৃন্দকে মিথ্যা, বানোয়াট মামলায় আসামী করা হয়েছে। মিরসরাইয়ে ছাত্র আন্দোলন তো দুরের কথা একজন ছাত্রও রাস্তায় নামেনি। তাহলে কেন এই মামলা, হয়রানি। জনগন এর দাঁতভাঙ্গা জবাব দেবে ইনশাআল্লাহ।

বিএনপির কেন্দ্রীয় দফতর সূত্র জানায়, এমনিতেই সারা দেশে ১৮ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে প্রায় ৭৮ হাজার মামলা ঝুলছে। নতুন মামলাও হচ্ছে। আবার পুরনো মামলাগুলো সচল করেও কাউকে কাউকে গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে। এর মধ্যে দলের চেয়ারপারসন কারাবন্দী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেই ৩৫টি মামলা রয়েছে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশের পর ঢাকা মহানগরীর বহু নেতাকর্মীর নামে নতুন মামলা দেয়া হয়েছে। অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত ৩ সেপ্টেম্বর বিএনপির স্বেচ্ছাসেবক সম্পাদক মীর সরফত আলী সপুকে প্রধান আসামি ও ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে ঢাকার লালবাগ থানায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে একটি নতুন মামলা দায়ের করেছেন নবাবগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো: আনিসুল ইসলাম। সরফত আলী সপু জানান, তাকে যে মামলায় আসামি করা হয়েছে তার সাথে কোনোভাবেই তিনি সম্পৃক্ত নন। এটি একটি মিথ্যা, বানোয়াট ও পরিকল্পিত মামলা। এভাবে আরো অনেক নেতাকর্মীর নামে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে বলে দফতর সূত্র জানায়।

বিএনপির দফতর সূত্র জানায়, বুধবার ঢাকা মহানগরীর সূত্রাপুর থানায় বিএনপি নেতা আবদুস সাত্তার, জাবেদ কামাল রুবেল, আবু সাহেদ মিন্টু, আনু ও দেলোয়ারসহ ২০ জনের নামে দু’টি মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। কুষ্টিয়ার বিভিন্ন উপজেলায় বিএনপির নেতাকর্মীদের নামে ১০টি মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের মোট ২৭ জনের নামে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, দেশব্যাপী আবারো নতুন করে বিশেষ ক্ষমতা আইনে অথবা নিজেরাই নাশকতার মতো ঘটনা ঘটিয়ে বিএনপি ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের নামে মামলা দিয়ে নির্বিচারে গ্রেফতার করছে পুলিশ। কারণ শেখ হাসিনা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে চান না। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তার লজ্জাজনক পরাজয় হবে। সে জন্য একতরফা ভোটারশূন্য নির্বাচন করতে তিনি সারা দেশে বিরোধী দলশূন্য করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। ঢাকা সহ সারা দেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের বাড়ি ও পরিবার ছাড়া পলাতক জীবন বেছে নিতে হয়েছে। প্রতি দিন রাতেই পোশাকধারী ও সাদা পোশাকধারীরা বিএনপি নেতাদের বাসাবাড়িতে হানা দিচ্ছে। তল্লাশির নামে পরিবারের সদস্যদের সাথে করা হচ্ছে দুর্ব্যবহার, গ্রেফতার করছে এবং জলোচ্ছ্বাসের মতো মামলা দিয়ে সারাদেশকে ভাসিয়ে দেয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, সরকারের বাহিনীগুলো বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। দমন-পীড়নের তীব্র মাত্রার পরও জাতীয়তাবাদী শক্তির ক্ষয় হয়নি। জনগণের নীরব ক্ষোভ প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। সরকার যত জুলুম করছে ততই সরকারের পতন ঘনিয়ে আসছে। জনগণের সাথে প্রতারণার মাশুল সরকারকে দিতেই হবে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেলের ডিসি মাসুদুর রহমান বলেছেন, যাদের বিরুদ্ধে মামলা বা গেফতারি পরোয়ানা রয়েছে শুধু তাদেরকেই গ্রেফতার করা হচ্ছে, এর বাইরে কোনো গ্রেফতার নেই।
মেহেরপুর সংবাদদাতা জানান, মেহেরপুর সদর থানা পুলিশ বিএনপি-জামায়াতের ১৯ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে বিএনপির ১১ ও জামায়াতের ৮ জন স্থানীয় নেতাকর্মী রয়েছেন। এর আগে মঙ্গলবার ভোর রাতে জেলার গাংনী থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে বিএনপি-জামায়াতের ২৩ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠিয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here