ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে আর চট্টগ্রামের মানবিক পুলিশ যেখানেই যায়, সেখানেই কোনো না কোনো উদাহরণ তৈরি করে আসে। পেশাগত কাজে চট্টগ্রাম থেকে টাঙ্গাইলে গিয়েও রচিত হল সেই একই কাহিনী।
টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানার ফতেহপুর ইউনিয়নের বাদ্যকর পাড়া গ্রাম। সেই গ্রামের এক কোণায় ছাউনি ঢাকা ভাঙ্গা ঘরে থাকেন শতবর্ষী মিনুকা রানী দাশ ও তার মেয়ে কাঞ্চন মনি দাশ। মেয়ে কাঞ্চন মণি দাশের বয়সও আশির কোটায়। মিনুকা রাণীর বিয়ে হয়েছিল মাত্র ১২ বছর বয়সে। বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় মারা যান তার স্বামী। সেই হিসেবও ৩০ বছর আগের। মিনুকা রাণী বাকপ্রতিবন্ধী আর মেয়ে শ্রবণ প্রতিবন্ধী। বিয়ের পরপরই মিনুকার কোলজুড়ে আসে তিন সন্তান। স্বামী মারা যাওয়ার পর অন্যের বাসায় কাজ করে সন্তানদের বড় করতে থাকেন। কিন্তু ছেলেরা একটু বড় হয়েই পিসতুতো ভাইদের সাথে চলে যান ভারত। মেয়ের বিয়ে দিলে সেও বিধবা হয়ে ফিরে আসে। সারাদিন মা-মেয়ে জমি ও রাস্তা থেকে গোবর কুড়িয়ে এনে ঘুঁটে বানিয়ে অন্যের বাসায় দিয়ে আসলে দুটো খাবার পান। ঘুটো না বানাতে পারলে মা-মেয়েকে থাকতে হয় না খেয়ে।
এই মিনুকা রাণী আর কাঞ্চনা মনির পাশে দাঁড়ালেন চট্টগ্রাম মানবিক পুলিশ ইউনিটের টিমলিডার শওকত হোসেন। তিনি টাঙ্গাইলের মোহরায় একটা ট্রেনিংয়ের কাজে গিয়েছিলেন। সেখানে মা-মেয়ের থাকার জন্য খাট, তোষক, কম্বল বানিয়ে দেন। মাসখানেকের বাজারও করে দিয়ে এসেছেন। আশা করছেন মাসখানেকের মধ্যে মা-মেয়ের জন্য তৈরি করা হবে নতুন ঘর।
এরকম অনেক মানবিক জীবনের গল্প জমা আছে শওকত হোসেন ও তার মানবিক পুলিশ ইউনিটের ঝুলিতে। শরীরে ক্ষত নিয়ে রাস্তার পাশে কাউকে পড়ে থাকতে দেখলেই ছুটে যান তারা।
২০০৫ সালে পুলিশে যোগ দিয়েই পুলিশ কনস্টেবল মুহাম্মদ শওকত হোসেনের চোখে পড়ে অসহায়, দুঃস্থ ও বেওয়ারিশ মানুষরা নিভৃতে কাঁদে। ভেবেছিলেন পুলিশে চাকরি করবেন না, কারণ কষ্ট হয়। পরে পরিবারের লোকজনের কথায় সিদ্ধান্ত নিলেন কিছুদিন চাকরি করবেন। তখন দেখলেন, পুলিশে চাকরি করে তিনি অনেক মানুষের উপকার করতে পারছেন। কাউকে অন্যায়ভাবে নির্যাতন করছে, তিনি তার সাপোর্ট হিসেবে দাঁড়াতে পারছেন। কাউকে জোরপূর্বক কিছু চাপিয়ে দিলে বা বলপ্রয়োগ করলে তাকেও সাপোর্ট দিতে পারছেন। সবমিলিয়ে দেখলেন, পুলিশে চাকরি করে অনেক সেবামূলক কাজ করা যায়। তখন থেকে মানুষের জন্য কাজ করার ইচ্ছা বাড়তে থাকে।
তিন বছরের ডিপ্লোমা এবং দুই বছরের প্যারামেডিকেল কোর্স থাকায় ২০১০ সালের দিকে শওকত হোসেনের পোস্টিং হয় চট্টগ্রাম বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালে। শুরুর দিকের কথা বলতে গিয়ে শওকত হোসেন বলেন, ‘মাঝেমধ্যে ডাস্টবিনে, ড্রেন ও বহুতল ভবনের পাশে, ময়লা-আবর্জনা ফেলে এমন জায়গায় অসহায় মানুষদের শরীরে ক্ষত নিয়ে পড়ে থাকতে দেখি। তাদের অনেকের গায়েই পোকা পড়ে গেছে, তাদের মধ্যে মানসিক প্রতিবন্ধীও আছে। ওইসব মানুষকে দেখে খুব খারাপ লাগে। গায়ে দূর্গন্ধ থাকায় কোনো মানুষ তার পাশ দিয়ে চলাচলও করে না। পোকাগুলো তাদের শরীরটাকে খেয়ে ফেলছে। চিন্তা করলাম সৃষ্টির সেরা জীব এভাবে শেষ হবে? কিছু করা উচিত। মন কাঁদত, কিন্তু প্রথমে আমিও এদের ধরতাম না।’
তিনি বলেন, ‘২০১০ সালের মাঝামাঝি সময়, এক পুলিশ সদস্যকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথে রাস্তার পাশে এক মানসিক ও বাকপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে দেখি, তার শরীরের একাংশে পোকা ধরে গেছে। তাকে দেখে রাতে ঘুম এলো না। চিন্তা করতাম- ওই লোক যদি আমার ভাই, বাবা বা মা হতো, আমি কী করতাম? আমি কি এভাবে চলে আসতে পারতাম? আমি আমার বিবেকের কাছে পরাজিত হই। পরের দিন সকালে সিদ্ধান্ত নেই, আমি তাকে মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা করাবো।’
শওকত হোসেন বলেন, ‘গ্লাভস-মাস্ক পরে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই৷ আমার গায়ে পুলিশের পোশাক থাকায় তারা ভর্তি নেয়। বলে যে, আপনি তো ভর্তি করিয়ে চলে যাবেন, এরপর তার পরিচর্যার দায়িত্বে কে থাকবেন? কোনো মানুষের কেউ না থাকলে কি পচে মরে যাবে? আমি এই যুক্তি দেখাই। কিন্তু উনাদের বাস্তব যুক্তির কাছে আমি হেরে যাই। দুদিন পর আমি ওই ওয়ার্ডে গিয়ে দেখি ওই রোগী নেই। খোঁজ নিলে তারা জানায়, দূর্গন্ধে অন্য রোগীদের সমস্যা হওয়ায় ওই রোগীকে তারা সেই ডাস্টবিনের পাশে রেখে এসেছেন। আমি চিন্তা করলাম শরীরে পোকা ধরার পর যে মানুষটি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, সে আমাদের পুরো সমাজ ও জাতিকে অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছে। হয়ত সে ভাবছে, পৃথিবীতে এমন মানুষ কি কেউ নেই যে তাকে সহযোগিতা করবে। এভাবে একজন মানুষ নিঃশেষ হয়ে যাবে? কেউ রেসপন্স করবে না? আমি মেনে নিতে পারি না। সিদ্ধান্ত নিলাম, কেউ ইনভল্ব না হলেও আমি ইনভল্ব হবো। আমার প্যারামেডিকেল কোর্স করা থাকায় এবং হাসপাতালের কাজে অভিজ্ঞতা থাকায় আমি এদের নিয়ে একাই ২০১২ সাল পর্যন্ত কাজ করি।’
যেভাবে হলো মানবিক টিম
বেওয়ারিশ মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় কাজ করতে সমস্যা হচ্ছিল। কারণ পুলিশ কনস্টেবল শওকত হোসেনের একার পক্ষে সব বেওয়ারিশের দেখাশোনা করা সম্ভব হচ্ছিল না। চট্টগ্রামের সদ্যবিদায়ী পুলিশ কমিশনার মাহাবুবর রহমানকে বিষয়টি বলার পর তিনি একটি মানবিক টিম গঠন করে দেন।
চট্টগ্রামের মানবিক পুলিশের মায়াভরা গল্প 2
২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর এই ইউনিট গঠনে অফিস আদেশ জারি করা হয়। সিএমপির উপ-কমিশনারকে (সদর) প্রধান করে ১০ সদস্যের এই ইউনিটে দুইজন অতিরিক্ত উপ-কমিশনার, পুলিশ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক, চারজন সহকারী কমিশনার, একজন পরিদর্শকের পাশাপাশি রাখা হয় প্রায় এক যুগ ধরে বছর ধরে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা মেগট আক্রান্ত, স্বজনহীন লোকদের সেবাদানকারী পুলিশ কনস্টেবল শওকতকে। এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়, নবগঠিত এ ইউনিট দুস্থ ও অভিভাবকহীন রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা ব্যবস্থার পাশাপাশি খাওয়া ও পোশাকের ব্যবস্থা করবে। এছাড়াও গুরুতর অসুস্থ রোগীদের শরীরে অস্ত্রোপচার ও পরবর্তী পরিচর্যার পাশাপাশি আইনি সহায়তা করবে এ ইউনিট।
এক বছর আগে মানবিক পুলিশ ইউনিট গঠন হলেও সেই ২০১১ সাল থেকে শরীরে পচন ধরে পোকায় আক্রান্ত (মেগট) রাস্তার পাশে পড়ে থাকা স্বজনহীন লোকদের নিজেদের উদ্যোগে নিভৃতে সেবা দিয়ে আসছিলেন চট্টগ্রামের দামপাড়া বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালে কর্মরত সাত কনস্টেবল মো. শওকত হোসেন, মো. হান্নান, মো. মাঈনুদ্দীন, মো. মাহবুবুল আলম, মো, ইয়াছিন আরাফাত, মো. রবিউল হোসেন এবং মো. এমরান হোসেন। সবমিলিয়ে তারা এ পর্যন্ত হাজারখানেক মানুষকে সেবা দিয়েছেন। প্রতিদিন অন্তত ২০ জন বেওয়ারিশ মানুষের খাওয়ার ব্যবস্থা করছেন।
শওকত হোসেন বলেন, টাকার অভাবে যারা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অপারেশন করতে পারে না, তাদের অপারেশনের ব্যবস্থা করা হয়। যাদের লাশ মেডিকেল থেকে নেওয়ার মত টাকা নেই, আমরা তাদের দাফন কাফনসহ পৌঁছানোর দায়িত্ব আমরা কাঁধে নিই। এটি চলমান। এখন প্রতিদিন ২০ জন বেওয়ারিশ মানুষের খাওয়ার ব্যবস্থা করছি। একটি শেড হলে সেখানে ১০০ জনের খাবার রান্না হবে। বেওয়ারিশ মানুষ ওখানে এলে খাবার ও কাপড় পাবে। সরকারিভাবে না হলেও সুশীল সমাজের মানুষদের অনুদানে এটা করতে চাই।
ভবিষ্যৎ ইচ্ছের কথা জানাতে গিয়ে শওকত জানালেন, তার ইচ্ছে চট্টগ্রামে একটি বেওয়ারিশ হাসপাতাল হোক। যারা রাস্তাঘাটে পোকা ও কুকুরের কামড় খেয়ে বেঁচে থাকে তাদের সরকারি হাসপাতালে জায়গা হয় না। কারণ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অন্য রোগীর মধ্যে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। তাই তিনি চান এ ধরনের রোগীদের চিকিৎসায় চট্টগ্রামে একটি বেওয়ারিশ হাসপাতাল হোক।
তিনি বলেন, আমি চাই সরকার সব বিভাগীয় মেডিকেল কলেজে নিঃস্ব ও বেওয়ারিশ ওয়ার্ড চালু করবে এবং সেখানে বিনা পয়সায় তারা চিকিৎসার পাশাপাশি ওষুধও পাবে।