ভোটের চমক/ চট্টগ্রাম সিটির নির্বাচনে ‌নজর থাকবে যাদের ওপর

216

 

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে ৪১টি সাধারণ ও ১৪টি মহিলা ওয়ার্ডে ৫৫টি কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের দুই শতাধিক নেতা প্রার্থী হয়েছেন এবার। এদের বেশিরভাগই নামে স্বতন্ত্র প্রার্থী। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীদের হটিয়ে এদের অনেকেই জিতে আসতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ এলাকায় এদের বেশিরভাগেরই প্রভাব বেশ ভালো। তবে স্থানীয় প্রশাসন অনেক এলাকাতেই অতি উৎসাহীর ভূমিকা নেওয়ায় নির্বাচন চরমভাবে বিতর্কিত ও সংঘাতপূর্ণ হতে পারে বলে মনে করছেন খোদ সরকারি দলের নেতারাই।

এই প্রথমবারের মত দলের ব্যানারে অনুষ্ঠিত চসিক নির্বাচনে এবার কাউন্সিলর পদে সাধারণ ওয়ার্ডের মোট ১৩ জন সদ্য সাবেক কাউন্সিলর ‘অস্বাভাবিকভাবে’ শাসক দল আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত হন। ‘বিদ্রোহী’ তকমা নিয়ে এই ১৩ জনের মধ্যে ১৩ নম্বর পাহাড়তলীর মোহাম্মদ হোসেন হীরণ ছাড়া বাকি ১২ জনই ভোটের মাঠে অংশ নেন। এর মধ্যে ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের তারেক সোলায়মান সেলিম ক্যান্সারে এবং ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে মাজাহারুল ইসলাম চৌধুরী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। আর ২৫ নম্বর রামপুরায় এসএম এরশাদ উল্লাহ দলীয় প্রার্থী আব্দুস সবুর লিটনের সমর্থনে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে ‘সরে’ দাঁড়ান।

বিদ্রোহী প্রার্থী ইস্যুতে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ, প্রশাসন ও দলীয় মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীদের চরম চাপ, হুমকি ধমকি উপেক্ষা করে এখনো ভোটের মাঠে আছেন ৯ সাবেক কাউন্সিলর। তবে এই মুহূর্তে দলের সিনিয়র নেতারা বিদ্রোহী কাউন্সিলর ইস্যুতে অনেকটা নীরব ও নমনীয় হলেও কিছু কিছু এলাকায় অতি উৎসাহীর ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসনকে।

শেষ মুহূর্তেও সদর্পে ৯ বিদ্রোহী

বিদ্রোহীদের মাঝে ভোটের মাঠে সদর্পেই টিকে আছেন— ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের তৌফিক আহমেদ চৌধুরী, ২ নম্বর জালালাবাদে সাহেদ ইকবাল বাবু, ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলীতে জহুরুল আলম জসীম, ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলীতে মোরশেদ আক্তার চৌধুরী, ১২ নম্বর সরাইপাড়া ওয়ার্ডে সাবের আহমেদ, ১৪ নম্বর লালখানবাজারে এফ কবির মানিক, ২৭ নম্বর দক্ষিণ আগ্রাবাদে এইচএম সোহেল, ২৮ নম্বর পাঠানটুলীতে আব্দুল কাদের ও ৩৩ নম্বর ফিরিঙ্গীবাজারে হাসান মুরাদ বিপ্লব।

এবারের ভোটে যা কিছু নির্বাচনী আমেজ তার বড় একটা কৃতিত্ব পাবেন ‘বিদ্রোহী’ এই ৯ সাবেক কাউন্সিলর। শুরুর দিকে এই বিদ্রোহীদের কেউ কেউ মাঠে কোণঠাসা থাকলেও করোনায় নির্বাচন স্থগিত হওয়ার পর করোনাকালে নিজেদের মাঠ গুছিয়ে নিতে পেরেছেন এসব প্রার্থী। এই মুহূর্তে এদের বেশিরভাগই ভোটের মাঠে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন। নির্বাচনের শুরু থেকে আলোচনায় থাকা এই ৯ বিদ্রোহী প্রার্থী এবারের ভোটে আলাদা করে নজর কাড়বেন সন্দেহ নেই। তবে এর বাইরেও রয়েছে চমক। সেভাবে আলোচনায় না থাকা অনেক প্রার্থী দৃশ্যত ধারণার চেয়েও বেশি এগিয়ে গেছেন ভোটের মাঠে। যেমন— ৪ নম্বর চাঁন্দগাও ওয়ার্ডের এসরারুল হক কিংবা ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের আলমগীর হাসান।

হঠাৎ লাইমলাইটে এসরার
৪ নম্বর চাঁন্দগাও ওয়ার্ডে সাবেক কাউন্সিলর সাইফুদ্দিন খালেদ সাইফু দলীয় মনোনয়ন পেলেও তাকে ঠেকাতে মাঠে আছেন আওয়ামী লীগের ৪ বিদ্রোহী। সাইফুর সাথে চাঁন্দগাওয়ের সাবেক সাংসদ নুরুল ইসলাম বিএসসির ছেলে মুজিবুর রহমানের বিরোধ এলাকায় বেশ আলোচিত। এই ওয়ার্ডের ভোটে প্রভাব রয়েছে মুজিবুরের। সাইফুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী ৪ প্রার্থীর মধ্যে এসরারুল হক এসরার ও আনিসুর রহমান রয়েছেন সুবিধাজনক অবস্থানে। দুজনই মুজিবুরের ঘনিষ্ঠ। এর মধ্যে আনিস বিএসসির আপন ভাতিজা। অন্যদিকে এখানে বিএনপির একক প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন মাহবুবুল আলম। তবে স্থানীয় রাজনীতিতে তিনি আবু সুফিয়ানের অনুসারী হওয়ায় এই এলাকায় মোর্শেদ খানের অনুসারীরা এসরার ও আনিসের সাথে কাজ করছে। এই দুজনের মধ্যেই এই ওয়ার্ডে নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে বলে জানিয়েছে স্থানীয় সূত্রগুলো। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত এসরারুল হক এসরার এগিয়ে থাকলেও বিএসসির আপন ভাতিজা আনিসের সম্ভাবনা একদমই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

ওয়াসিমের ঘাড়ে মাহমুদুরের উষ্ণ নিশ্বাস
১৩ নম্বর পাহাড়তলীতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী নগর যুবলীগের সদস্য ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী। ৪১ ওয়ার্ডে মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীদের মধ্যে যারা ‘হেভিওয়েট’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন তাদের মধ্যে ওয়াসিমও একজন। এলাকায় ওয়াসিমের ভাল জনসমর্থনও রয়েছে। এই ওয়ার্ডে ওয়াসিমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন মাহমুদুর রহমান। নির্বাচনী প্রচার প্রচারণায় ওয়াসিমকে শক্ত চ্যালেঞ্জ জানাতে সক্ষম হয়ে আলাদা করে নজর কেড়েছেন মাহমুদুর। এই ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন হীরণ ভোটের স্থানীয় রাজনীতিতে বেশ বড় ধরনের একটি ফ্যাক্টর। মাহমুদকেই সমর্থন দিচ্ছেন তিনি। হেভিওয়েট ওয়াসিমের বিরুদ্ধে হীরনের হয়ে মাহমুদুর চমক দেখাতেও পারেন— এই সম্ভাবনা প্রচার-প্রচারণায় সময়েই ভালভাবে জানান দিয়েছেন তিনি।

মুনিরনগর কি মোর্শেদের চমক দেখতে যাচ্ছে?
৩৭ নম্বর মুনিরনগর ওয়ার্ডে গতবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন জামায়াতে ইসলামের শফিউল আলম। এখানে এবার আওয়ামী লীগ থেকে আব্দুল মান্নানকে মনোনয়ন দেওয়া হলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা তাকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে মানছেন না। এখানে মান্নানের বিরুদ্ধে নির্বাচন করছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ সম্পাদক মেজবাহ উদ্দিন মোর্শেদ ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মো. সালাউদ্দিন। মেজবাহ উদ্দিন মোর্শেদ শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেলের অনুসারী। নির্বাচনের মাঠে বেশ শক্ত অবস্থান নিয়েছেন তিনি। সর্বশেষ মোর্শেদের সমর্থনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন ইবনে মবিন ফারুক শিপু— যিনি গত নির্বাচনে ২৯০০ ভোট পেয়েছিলেন। শিপুর সমর্থন মোর্শেদকে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে। এখানে শফিউল আলমের সাথে মোর্শেদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার সম্ভাবনার কথাই উঠে আসছে স্থানীয়দের কাছ থেকে। একেবারে তরুণ প্রার্থী মোর্শেদ এখানে জয়ী হয়ে আসলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

এবার কি অন্য রূপ দেখবে চকবাজার?
চকবাজারে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন ৫ বারের কাউন্সিলর সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টু। তবে তিনি আওয়ামী লীগের কেউ নন দাবি করে প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনও করেছে চকবাজার থানা আওয়ামী লীগ। এই ওয়ার্ডে মিন্টুর বিরুদ্ধে লড়ছেন নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা দেলোয়ার হোসেন ফরহাদ। চকবাজার আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির ছেলে তিনি। তার এক ভাই জামায়াতের সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হওয়ার পর তার পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দিতে তাদের ঘরে ছুটে এসেছিলেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ত্যাগী পরিবারের সন্তান ফরহাদকে সমর্থন যোগাচ্ছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বড় একটা অংশ। মিন্টুর বিরুদ্ধে এখানে চমক দেখাতে পারেন ফরহাদও।

এরই মধ্যে হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ১৬নং চকবাজার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টুর প্রার্থিতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে নির্বাচন কমিশনকে কারণ দর্শানোর আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। সোমবার (২৫ জানুয়ারি) একটি রিটের শুনানি শেষে হাইকোর্টের বিচারপতি খসরুজ্জামান ও বিচারপতি হাসান মাহমুদ তালুকদারের দ্বৈত বেঞ্চে শুনানি শেষে এ আদেশ দেওয়া হয়। সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টু দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় অভিযুক্ত। অথচ নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামায় এই তথ্যটি তিনি গোপন করেছেন।

বাকলিয়ায় কঠিন পরীক্ষায় ডিউক
‘বিএনপির দূর্গ’ হিসেবে পরিচিত বাকলিয়ার ৪ ওয়ার্ডের মধ্যে কেবলমাত্র ১৭ নম্বর পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডে বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীকে প্রচার প্রচারণায় বেশ সরব দেখা যাচ্ছে। এই ওয়ার্ডে আগের দুই নির্বাচনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপি জাফরুল ইসলাম। পরে তার মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে জয়ী হন তার ছেলে একেএম আরিফুল ইসলাম ডিউক। এবারও তাকে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। গতবার পিতার মৃত্যুর পর সিম্পেথি ভোটে জিতে আসা ডিউককে এবার কঠিন পরীক্ষাই দিতে হবে। কারণ বিএনপির দূর্গে পতন ঘটানোর বিষয়ে আওয়ামী লীগের ওপরমহল অনেকটাই মরিয়া।

৪১ নম্বর দক্ষিণ পতেঙ্গায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী এই ওয়ার্ড থেকে ৩ বারের নির্বাচিত কাউন্সিলর ছালেহ আহমদ চৌধুরী। এই ওয়ার্ডে তাকে হেভিওয়েট প্রার্থীই বলা চলে। তবে এবারের নির্বাচনে তাকে অনেকটা অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থী মো. আলমগীর। ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলমের সমর্থন পাচ্ছেন তিনি। ছালেহ আহমদের বিরুদ্ধে আরও দুই বিদ্রোহী প্রার্থী থাকলেও ছালেহ আহমদের লড়াইটা কঠিন করা ছাড়া বিশেষ কিছু করার সম্ভাবনা নেই তাদের। তবে এক্ষেত্রে এটি আশীর্বাদ হয়ে দাড়াতে পারে আলমগীরের জন্য। ছালেহ আহমদের বিরুদ্ধে এখানে আলমগীর জিতে আসার সুযোগ তাই একেবারেই ফেলে দেয়া যাচ্ছেনা। তবে এখানে জয়ের ভাল সম্ভাবনা রয়েছে বিএনপি প্রার্থী নুরুল আবছারেরও।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here