সোনা পাচারে ট্রানজিট পয়েন্ট রিয়াজউদ্দিন বাজার

707

সোনা চোরা চালানের রুট চট্টগ্রাম। নগরীর রিয়াজ উদ্দিন বাজারকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসাবে ব্যবহার করছে সোনা পাচারকারীরা। সেখানে রয়েছে স্বর্ণ পাচারকারীদের ২০ জনের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। গত রবিবার মিরসরাই জোরারগঞ্জ থেকে ৬০০ ও নগরীর সিআরবি এলাকা থেকে উদ্ধার হওয়া এক’শসহ মোট ৭’শ সোনার বারের উৎসস্থল ছিলো রিয়াজ উদ্দিন বাজার। দুটি ঘটনায় গ্রেপ্তার চারজনের বক্তব্যও ছিলো অভিন্ন। সবগুলো স্বর্ণের বারে ইউএই লিখা ছিল। প্রতিটি বার ছিলো ২৪ ক্যারেটের। ধারণা করা হচ্ছে একটি সিন্ডিকেট স্বর্ণগুলো পাচার করছিলো।
গতকাল (সোমবার) জেলা পুলিশ লাইন্সে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রামের জেলা পুলিশ সুপার নূরে আলম মীনা জানান, জোরারগঞ্জ থেকে উদ্ধার করা স্বর্ণবারগুলোতে ইউএই লেখা ছিলো। এতেই বুঝা যায় স্বর্ণগুলো দুবাই থেকে এসেছে। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, নগরীর রিয়াজ উদ্দিন বাজার এলাকা থেকে স্বর্ণগুলো গাড়িতে উঠানো হয়েছে।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের বন্দর জোনের উপ -কমিশনার (ডিসি) এস এম মোস্তাইন হোসেন জানান, সিআরবি থেকে উদ্ধার করা স্বর্ণের বারেও ইউএই লিখা রয়েছে। এতে সহজেই বুঝা যায় স্বর্ণগুলো দুবাই থেকে এসেছে। প্রতিটি বারের ওজন ২৪ ক্যারেট।
খোঁজনিয়ে জানা যায়, গোয়েন্দা পুলিশের উদ্ধার করা স্বর্ণের বারগুলোও রিয়াজ উদ্দিন বাজার থেকে সরবরাহ করা হয়েছে। সিআরবি-দামপাড়া জিইসি হয়ে তাদের যাবার কথা ছিলো।
দুটি স্বর্ণ উদ্ধারের ঘটনায় চারজন বহনকারী ধরা পড়েছে। পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে চারজনই জানিয়েছে যারা স্বর্ণগুলো দিয়েছে তাদের চিনে না। তারা নির্দিষ্ট অংকের অর্থের বিনিময়ে স্বর্ণগুলো বহন করে থাকে।
আকাশ, নৌ এবং স্থলপথ, চোরাই স্বর্ণের চালান আসছে দেশের সব পথ ধরেই। আকাশপথে নজরদারি বাড়লে নৌপথে সক্রিয় হয় চোরাচালানি চক্র। আবার নৌপথ কঠিন হলে স্থলপথে তারা ব্যস্ত। পথের পরিবর্তন হয়। শেষ নেই স্বর্ণ চোরাচালানের। বানের পানির মতো স্বর্ণের চালান দেশে ঢুকছেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, দুবাই থেকে এক কেজি সোনা ঢাকায় আনলে লাভ ৪ লাখ টাকা। একই সোনা ভারতে নিতে পারলে সেই লাভ গিয়ে দাঁড়ায় ১০ লাখে। হালে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চোরাই পণ্যের বিনিময় মূল্য হিসেবে স্বর্ণের ব্যবহার। সীমান্তের চোরাই পথে ভারতীয় গরু আসছে। আর এই গরুর মূল্য পরিশোধ হচ্ছে এখন স্বর্ণ দিয়ে। বিপুল অঙ্কের লাভ এবং বিনিময় মূল্য হিসাবে স্বর্ণ ব্যবহারের কারণে দেশে স্বর্ণ চোরাচালান বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। আর এই স্বর্ণের চালান আসছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দর হয়ে। আবার মিয়ানমার ও মালয়েশিয়া থেকে ট্রলারযোগে কক্সবাজার এবং টেকনাফেও আসছে স্বর্ণের চালান। সেই স্বর্ণের চালান স্থল ও রেলপথে ঢাকা আনা হয়। ঢাকা থেকেই পাঠানো হচ্ছে তার প্রকৃত গন্তব্যে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছে, আটক হওয়া স্বর্ণ চোরাচালানের দশ ভাগের এক ভাগেরও সমান নয়। ভারতে সোনার বাজারের সিংহভাগ বাংলাদেশ থেকে চোরাই পথে পাচার হচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, বিমানবন্দর, বঙ্গোপসাগর, মিয়ানমারের বিভিন্ন রুট হয়ে দেশে এসব স্বর্ণের চালান আসছে।
২০১৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে ১৪ কেজি ওজনের ১২৫ টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করেছিলো শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। ঐ স্বর্ণপাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে সেই সময় গ্রেপ্তার হয়েছিলো বাংলাদেশ বিমানের মেকানিক আবদুস সাত্তার ও স্বর্ণ পাচারকারী মাহমুদুর রহমান রনি। ছাত্তার চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমান বন্দরে কর্মরত ছিলো। রনির বাড়িও চট্টগ্রামে। শুল্ক গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছিলো বাংলাদেশ বিমানের দুবাই-চট্টগ্রাম-ঢাকা ফ্লাইটে স্বর্ণ বহন করা হয় সবচেয়ে বেশি। এ ফ্লাইট ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামে অবতরণ করার পর অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট হয়ে যায়। এ সুযোগে স্বর্ণ বহনকারীরা অভ্যন্তরীণ রুটের যাত্রী হিসাবে বিমানে উঠে যায়। দুবাই থেকে যারা স্বর্ণ বহন করে আনে তা ফ্লাইটের ভেতরেই হস্তান্তর হয়। বিমান বন্দরের ডমেস্টিক টার্মিনালে তেমন একটা তল্লাশি করা হয় না। এ সুযোগটাই স্বর্ণ পাচাকারীরা নেয় বলে জানা যায়।
জানা গেছে, সোনা আমদানি নীতি না থাকায় চোরাই পথে সোনা আসছেই। এ অবস্থায় একদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সোনা চোরাচালানের নিরাপদ রুট হিসেবে বাংলাদেশ পরিচিতি পাচ্ছে, অন্যদিকে দেশ হারাচ্ছে শত কোটি টাকার রাজস্ব। সোনা ব্যবসায়ী, কাস্টমস, বিমান, বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট প্রায় প্রতিটি সংস্থার কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে গঠিত সিন্ডিকেট এই সোনা পাচারের সঙ্গে জড়িত। চক্রের মূল হোতারা সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালেশিয়া ও ভারতে বসে চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছে। বিগত একবছরে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় আটক হওয়া সোনার গন্তব্য ছিল ভারত।
সূত্র জানায়, ভারতের বর্তমান চাহিদার যোগান দিতে বাংলাদেশে স্বর্ণ চোরাচালানের হার বেড়েছে অবিশ্বাস্য পরিমাণে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আকাশ পথে উড়ে আসা স্বর্ণের চালান যাচ্ছে ভারতে।
জানা যায়, ভারতে রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তর সোনা ও মণি-মুক্তা দিয়ে তৈরির অলঙ্কার শিল্পকারখানা। এ শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিশাল অবকাঠামো। এসব কারখানায় বছরে চাহিদা কমপক্ষে এক হাজার টন সোনা। কিন্তু কর বেড়ে যাওয়ায় আমদানিও কমে গেছে সেখানে। শিল্পকারখানাগুলো চরম সংকটে পড়ে। এতে আমাদানি প্রবাহ একেবারে কমে যায়। বৈধভাবে আমদানি করে আনা সোনার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা কারখানাগুলো বেছে নেয় বাঁকাপথ। শুধু কর ফাঁকি দিতে আমদানিকারকরা দুবাই থেকে চোরাইপথে সোনা আনার জন্য বেছে নেয় বাংলাদেশকে। ওরা খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে, দুবাই থেকে অনায়াসে সোনা কিনে তা ঢাকা হয়ে ভারতে নেওয়া যথেষ্ট সহজসাধ্য।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, দেশের দুটি বিমানবন্দর ইতিমধ্যে ধরা পড়া সোনার গন্তব্য ছিলো ভারত। ধরা পড়া বেশ কয়েকজন বাহক পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা হয়ে সোনা সড়কপথে নেওয়া হয় যশোর কিংবা ফেনীর সীমান্ত পথে। সেখান থেকে কলকাতা হয়ে সড়কপথেই সোনা যাচ্ছে জয়পুর-রাজস্থান-মুম্বাই -কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত কারখানায়। শুল্ক বিভাগ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রতিবছর কমপেক্ষে ৫ টন সোনার চাহিদা রয়েছে। গত পাঁচ বছরে দেশে আকাশপথে এক রতি সোনাও আমদানি করা হয়নি। তাহলে বাজারের চাহিদা মোতাবেক এ ৫ টন সোনা আসছে কোন পথে। কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের মোট চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ আনা হচ্ছে বৈধপথে। বাকি দুই ভাগ সোনাই আনা হচ্ছে চোরাচালানে।
দুবাই থেকে চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকা : অনুসন্ধানে জানা যায়, বড় চালানের বেশিরভাগই সোনা আসছে দুবাই থেকে। সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর থেকেও কিছু সোনা আসছে। অন্য দেশ থেকে আসা চালানগুলো খুব বেশি বড় নয়। তবে দুবাই থেকে চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকা পর্যন্ত একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট সক্রিয়। নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজারেও রয়েছে একটি শক্তিশালি সিন্ডিকেট। একই ধরনের সিন্ডিকেট রয়েছে কলকাতা, দিল্লি ও মুম্বাইয়ে। বারবার এত বড় বড় চালান কারা আনছে এর নায়ক কারা এটাই এখন বড় প্রশ্ন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মূল হোতা ধরা পড়ছে না। যে কজন ধরা পড়ছে তারা সোনার মালিক নয়। ওরা পেশাদার বহনকারী। ওরা শুধু স্টেশন টু স্টেশন ক্যারিয়ার। এ ব্যবসা করে তারা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here