মোজাম্মেল হোসেন চৌধুরী
১।
কাকডাকা ভোরে উঠে “সজল” কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। কাকডাকা বললে ভুল হবে কারন নিউইয়র্ক সিটি তে কাক দেখা যায় না। ভোর ৬ টার মধ্যে তাকে কাজে পৌছাতে হবে। মারিলান থেকে অকটন এ যেতে সময় লাগে ১ ঘন্টা। প্রতিদিন বাস-এ এইসময়টা সে ঘুমিয়ে নেয়। আজ ঘুম আসছে না। তাই বাস-এ বসে “সজল” বিগত দিনগুলির ভাবনায় চলে গেল। দেশে থাকতে কখনো দশটা’র আগে ঘুম থেকে উঠেনি।চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করেছে কিন্ত স্কুল জীবনের পর থেকে তার প্রতিদিনের নির্ধারিত ঘুম ছিল সকাল দশটা পর্যন্ত। দেশে তাদের অবস্থা অনেক ভালো না থাকলেও অসচ্ছল ছিল না। একদিন ডাকপিয়নের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত একটি চিঠি (ডিভি)-র হাত ধরে তার আমেরিকায় আগমন। তারপর ৬টি বছর কেটে গিয়েছে এখানে। এর মধ্যে একবার দেশে গিয়েছিল ।আমেরিকা তে একটি রেস্টুরেন্টে সে কাজ করে। “সজল” এই রেস্টুরেন্টে “Kitchen-Porter ” হিসেবে ঢুকেছিল। আমেরিকায় আসার পর বাঙ্গালী বড় ভাইয়েরা উপদেশ দিয়েছিল রেস্টুরেন্ট অথবা ইয়োলো ক্যাব-এ ঢুকার জন্য। এখানেই নাকি সব পয়সা। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না, তাই রেস্টুরেন্টে “Kitchen-Porter” হিসেবে তার আমেরিকায় কর্ম জীবনের শুরু। এভাবে তিনটি বছর কেটে গিয়েছে পরবর্তী এক বছর “হাফ-সেফ”-এ পদোন্নতি, তারপর “ফুল-সেফ ”। হায়রে আমেরিকা ! ব্যাংক বা কোন কর্পোরেট অফিসে পদোন্নতি নয়, রেস্টুরেন্টে পদোন্নতি। খারাপ নয়, কী-ই বা তার করার ছিল। ম্যানেজমেন্ট-এ ডিগ্রী দিয়ে এই দেশে কী করবে? টেকনিক্যাল জ্ঞান থাকলে না হয় অন্য কিছু একটা ভাবত।
বলা হয় আমেরিকা নাকি ওয়ান-ওয়ে কান্ট্রি। এই ওয়ান-ওয়ে কান্ট্রি কথাটি সজলের জীবনে সত্যি হয়ে গেল। Kitchen-Porter,হাপ-সেফ,ফুল-সেফ থেকে পেশা পরিবর্তন করে ক্যাব ড্রাইভার হয়ে গেল।ক্যাব চালিয়ে তার আয়-রোজগার বেশ ভালো। বন্ধুরা তাকে ক্ষেপায়, ইয়োলো ক্যাবের চাকা ঘুরলেই নাকি পয়সা। আয় ভালো হলেও কাজটি কিন্ত মোটেই সহজ নয়। অমনোযোগী হলেই মৃত্যু অবধারিত। মাঝে মাঝে তাকে প্যাসেঞ্জারের ব্যাগ এপার্টমেন্টে তুলে দিতে হয়। কাজটি বাধ্যতামুলক নয় , তবুও তাকে মাঝে মাঝে এটা করতে হয়। বন্ধুরা যে বলে ইয়োলো ক্যাব হলো আমেরিকায় রিক্সা চালানো—কথাটি মিথ্যা নয়। চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রী পাশ করার পর “সজল” ইচ্ছা ছিল “কস্ট এক্যাউন্টেন্ট” হওয়া। এজন্য সে আইসিএমএ-তে ভর্তিও হয়েছিল। কিন্ত আমেরিকায় আসার ভুত মাথায় চেপে যাবার পর সব বাদ দিয়ে সোনার হরিণের দেশ আমেরিকায় চলে এল। সে এখন একজন ক্যাবী। তার “কস্ট একাউন্টেন্ট” হবার স্বাদ হারিয়ে গেল, তাকে এখন সবাই বলে ক্যাবী।
২ .
সুজন দ্রুত দৌড়াচ্ছে। তাকে যতটা সম্ভব দ্রুত দৌড়াতে হবে। কারন সে লন্ডন এ Pizza ডেলিভারীর কাজ করে।যত বেশী ডেলিভারী দিতে পারবে, তত বেশী টিপস্। টিপস্ হল ডেলিভারী চাকুরীর প্রধান আয়। কিন্তু Pizza ডেলিভারির কাজ বছরের সব সময় থাকে না,যখন কলেজ ইউনিভার্সিটি Summer-Vacation হয় তখন এই ধরনের কাজ করা যায়।আর এই আয়ে বসরের বাকিটা সময় থাকা ,খাওয়া এবং কলেজ ইউনিভার্সিটি Tuition fess manage করতে হয়।এই আয়ের জন্যই সোনার হরিণের দেশে আসা ও সবাইকে নিজ দেশে ফেলে এখানে পড়ে থাকা। সুজন লন্ডন এসেছে প্রায় বছর চারেক হল।আসার পরই ডেলিভারী কাজে ঢুকেছে।তারপর অনেক কাজ বদল করেছে।কিন্ত শেষ পর্যন্ত আবার ডেলিভারী কাজেই ফিরে এসেছে।লন্ডন এ সব রকম অড জবের মধ্যে ডেলিভারী ও নাইট শিফট এর কাজ এ সবচেয়ে বেশী ইন্কাম।
সুজন এর দরকার টাকা। তাই সে এটাই করছে। ডেলিভারী কাজে বেতন খুব কম হলেও টিপ্স থেকে প্রচূর আয় হয়।প্রথম দিকে টিপ্স নিতে খুব খারাপ লাগত কারন সে ছিল বাংলাদেশে রসায়নে স্নাতোকোত্তর।আর লন্ডন এ আসা এম,বি,এ পড়তে এবং এখানে এসে চেষ্টা করেছিল নিজ পেশায় কিছু করতে।রসায়নে স্নাতোকোত্তর সার্টিফিকেটের মূল্যায়ন ও হল না দুইহাজার বছরের পুরনো শহর লন্ডন এ।তার তো সিভিল,মেকানিক্যাল, ইলেট্রিক্যাল,কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মত টেকনিক্যাল কোন ডিগ্রী নাই। কম্পিউটার বিদ্যাও টাইপিং পর্যন্তই। তাই ডেলিভারীর কাজ নিয়ে থাকতে হল,ভালো চাকরীর জন্য আবার একটা উচ্চতর ডিগ্রী নিতে হবে যেখানে দরকার প্রচূর অর্থের এবং সময়ের। তার কাছে তখন সেই সময় বা অর্থ কোনটাই ছিল না বা এখনও নাই। বরং দেশে অর্থ পাঠাতে হয় সংসার চালানোর জন্য। দেশে আছে ছোট ভাই ও ২ বোন। এক বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে, বাকী সবাই পড়াশোনা করছে, বাবা গত হয়েছে বছর দুই হল, সংসারের দায়িত্বটা এখন তার উপর।
সুজন ডেলিভারী কাজটা এখন ভালই উপভোগ করে। ডেলিভারী নিয়ে সুন্দর, সুন্দর আফিসে ঢুকে, ভেতরটা দেখতে পারে, মাঝে মাঝে অত্যধিক রকমের ভালো কিছু ব্রিটিশ মানুয এর প্রশংসা বাক্য শুনে। মাঝে মাঝে সুজন এর মনটা খুব খারাপ হয়ে যায় যখন কোন ডেলিভারীতে তাকে টিপস অ্যান্ড Thank you বলে না। আবার মাঝে মাঝে এই ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে যে, যদি এই অফিসে একদিন চাকুরী করতে পারতাম। সুজন এর ভালো অফিসিয়ালী একটা চাকুরী করার কথা ছিল। দেশে থাকলে তাই হতো কারন তার পরীক্ষার ফলাফল বরাবর ভালোই ছিল। কিন্ত তা হয়নি। ভাগ্যের কাছে সে বন্দী হয়ে অনেক উপার্জন করছে ঠিকই কিন্ত মানসিক শান্তি পাচ্ছে না। সাতটা প্যাকেট ডেলিভারী দেবার পর রেষ্টুরেন্টে ফিরছে আরে এসব ভাবছে। নাহ্, আজ আর কাজ করতে ইচ্ছে করছে না। আজ সে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে যাবে।
৩
আমার গল্পের শেষ নায়ক “সুমন”।সে ছিল খুবই ভাগ্যবান। কারন সে অস্ট্রেলিয়া এসেছিল পূর্ণতা নিয়ে অর্থাৎ সে এসেছিল তার স্ত্রী “কুলসুম বেগম” কে সাথে নিয়ে। দেশে পড়াশুনা শেষ করেই সে একটি Multinational company তে চাকুরী পেয়ে যায়। আর চাকুরী পাবার দুই বছর পরেই “কুলসুম “ এর সাথে বিয়ে। বিয়েটা ছিল বাবা-মায়ের পছন্দে। কুলসুম ছিল রূপবতী, শিক্ষিতা একটি মেয়ে। তারা সুখেই ছিল। তাদের সুখ আরো বৃদ্ধি পেল যখন বিয়ের দ্বিতীয় বছরের মাথায় অস্ট্রেলিয়া High skilled migration এর সুযোগ পেয়ে গেল। আত্মীয় স্বজন সবাই বলল, “সুমন” এর বউ ভাগ্যবতি।“কুলসুম বেগম” কে সাথে নিয়ে “সুমন” যথাসময়ে অস্ট্রেলিয়া এল। উঠেছিল দুর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাসায়। তারপর যথারীতি কাজ খোজা। একটা Telecom-company তে জব পেয়েও গেল। কিন্তুু জব টি ছিল সপ্তাহে তিন দিন নাইট শিফ্ট,তিন দিন ডে শিফ্ট। দুজনে একটা এক বেডরুমের বাসা নিল মেলবোর্ন শহর এ ।শুধুমাত্র সুমন এর আয়ে বাসা ভাড়া , ইউটিলিটি বিল, খাওয়া ও অন্যান্য খরচ চালানো খুবই কস্টের। তাই বাধ্য হয়ে কুলসুম কেও একটি চাকুরী নিতে হল। মেলবোর্ন এ তারা একটা ছোটখাট ছিমছাম সংসার শুরু হলেও বেশি দূর এগুতে পারলো না। চাকুরীতে অতৃপ্তি, পরস্পরকে সময় না দেয়ার অভিযোগ, বাসার কাজে কুলসুম কে সাহায্য না করার অভিযোগ – এসব খুটিনাটি ঝগড়া ওদের মধ্যে লেগেই থাকত। মাঝে মাঝে ঝগড়াটা বড় পর্যায়ে চলে যেত। ধীরে ধীরে অপূর্ন স্বাদগুলিও ঝগড়ায় স্থান পেতে লাগল যেমন তাদের একটা গাড়ী না থাকা, কিংবা বাসায় পর্যাপ্ত আসবাপপত্র না থাকা, কিংবা আদৌ তাদের একটা বাড়ী কখনো কেনা হবে কিনা! তিক্ততা থেকে দুরত্ব, দুরত্ব থেকে অন্য কোনদিকে আকর্ষণ। অস্ট্রেলিয়া আসার দেড় বছরের মাথায় সুমন কুলসুম কে হারিয়ে ফেলল। আরো বেশি কিছু বিলাসিতা, একটি নিরাপদ জীবন ও সুমন প্রতি হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসাকে নুতন করে খুজে পাবার আসায় “কুলসুম বেগম” একদিন “রিয়াদের” হাত ধরে চলে গেল। জীবন কখনো থেমে থাকে না।জীবন যায় চলে, কোন না কোন ভাবে।সুমন এর জীবনও থেমে নেই।
উপসংহারে ফিরে যাই,এই হল তিন বন্ধু। প্রত্যেকেই শিক্ষিত এবং ডিগ্রীধারী। দেশের অনিশ্চিত, অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজ দেশ ত্যাগ করে আমেরিকা,লন্ডন,অস্ট্রেলিয়া চলে এসেছে নিজেদের চমৎকার ভবিষ্যত গঠনের আশায়। এদের মত আরো অনেকেই এসেছে। কারো এখানে থাকা এবং কাজ করার বৈধ কাগজ আছে,কারো নাই।কেউ লেখাপড়া শেষ করায় নিজ দেশে ফিরে ব্যাবসা-বানিজ্য,চাকুরী বাকরী নিয়ে ব্যস্ত হতে চায় কিন্তু তাও সম্ভব নয় দেশের অস্তিতিশীল রাজনিতিক পরিস্থিতি ও নিতি নিরধারকের অভাব।সরকার যায় সরকার আসে কিন্তু এই তরুন প্রজন্ম কে নিয়ে কেউ ভাবে না।
এটি তো নিশ্চয় ঠিক নয়,জীবন যুদ্ধে সবাই জয়ী হবে ?যারা হেরে যায় তারা হেরে যায় বলেই অন্যরা জয়ী হয় ! অনেকে আবার যোগ্যতা থাকলেও এখানে যুদ্ধে নামতে পারেন না শ্রেফ লিগাল রেসিডেন্সি নেই বলে | আবার অনেকে কোনরকম শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়াই অনেক যোগ্য লোকের চেয়েও অর্থনৈতিকভাবে অনেক উপরে উঠে যাচ্ছেন এই প্রতিযোগিতার সুযোগের দেশে | আরেকটি বিষয় শুনতে হয়তো খারাপ লাগবে- আমাদের জাতিগত দৃষ্টিভঙ্গি এখনো ঘানা,নাইজেরিয়া,সোমালিয়ার সমপর্যায়ের। এ কারনে নিউইয়র্কের ক্যাব ড্রাইভাররা হয় মধ্য আফ্রিকার, নয়ত দক্ষিণ এশিয়ার। তবে প্রথম প্রজন্মের সব ইমিগ্র্যান্টদের এ অবস্থা ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত। যেমন প্রথম প্রজন্মের ইটালিয়ানরা হয় নাপিত নয়তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমেরিকান সৈনিক। অথবা প্রথম প্রজন্মের আইরিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক। সেক্ষেত্রে আমাদের অবস্থা বলা যায় অনেক ভালো। আমাদের দ্বিতীয় প্রজম্নের বাঙালীরা যেমন অর্জন করছে উচ্চ শিক্ষা, তেমনি যাচ্ছে ভালো-ভালো চাকরিতে।পরিশেষে এই কথাই বলতে চাচ্ছি অন্ধকারের উল্টোপিঠের আলোকিত দিকটাও আমাদের নিশ্চয় দেখা উচিত।
শেষ কথাঃআমি শুধু দেখাতে চেয়েছি , বাংলাদেশে অনেকেরই আমেরিকা,লন্ডন, অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কে অনেক রোমাঞ্চকর ধারণা আছে, অনেকেই হয়তবা ভেবে থাকেন যে আমেরিকা ,লন্ডন, অস্ট্রেলিয়া মানেই ডলার আর ব্রিটিশ পাউন্ড কিন্তু ডলার,ব্রিটিশ পাউন্ড কামাতে কতটা সংগ্রাম, কতটা কষ্ট করতে হয় – তারা হয়তবা অনেকেই জানেন না।
লেখকঃ
মোজাম্মেল হোসেন চৌধুরী
বি,এস, সি (অনার্স) কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং (ইউ,এস,টি ,সি,বাংলাদেশ)
এম ,এস,সি ইনফর্মেশন টেকনোলজি ম্যানেজমেন্ট (লন্ডন,ইউনাইটেড কিংডম)
E-mail:mozammal_ustc@yhaoo.com